কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৫, ০৯:৪৭ এএম
আপডেট : ২১ আগস্ট ২০২৫, ০১:৩৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

লুটের ২ শতাংশ পাথরও উদ্ধার হয়নি

পাথর লুট হাওয়ার আগের ও পরের চিত্র। ছবি : সংগৃহীত
পাথর লুট হাওয়ার আগের ও পরের চিত্র। ছবি : সংগৃহীত

গণঅভ্যুত্থানের মুখে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর থেকে সংঘবদ্ধ লুটপাটে সিলেটের সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্র রূপ নিয়েছে বালুচরে। সাদাপাথর, জাফলং, বিছনাকান্দি ও উৎমাছড়া পর্যটনকেন্দ্র থেকে ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে প্রায় ৪ কোটি ঘনফুট পাথর লুট করা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে শুরু থেকেই সংবাদ প্রকাশ করে আসছে কালবেলাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম। তাতে কর্ণপাত করেনি সিলেটের প্রশাসন। তবে লুটপাট শেষে শুরু হয় লোক দেখানো অভিযান। কিন্তু অভিযানে এখন পর্যন্ত লুট হওয়া ২ শতাংশ পাথরও উদ্ধার করতে পারেনি প্রশাসন।

কালবেলার নিজস্ব অনুসন্ধান, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) রাষ্ট্রীয় বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে উঠে এসেছে এসব তথ্য।

দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ইন্ধন ও সরাসরি সম্পৃক্ততায় রাষ্ট্রীয় সম্পদ কয়েকশ কোটি টাকা মূল্যের পাথর উত্তোলন করে তা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। নদী ও পর্যটন এলাকা থেকে পাথর চুরি করে প্রথমে স্থানীয় স্টোন ক্রাশার কারখানাগুলোয় জমা করা হয়। পরে এসব পাথর ভেঙে ছোট ছোট টুকরা করা হয়। যাতে চুরি করা পাথরের অস্তিত্ব না পাওয়া যায়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, লুট করা পাথর প্রতি ট্রাকে ৫০০ ঘনফুট করে সরিয়ে নেওয়া হতো। প্রতি ঘনফুট ১৮২ টাকা করে হিসাব করা হতো। সে হিসাবে ট্রাকপ্রতি পাথরের দাম পড়ে ৯১ হাজার টাকা। এখান থেকে ট্রাকপ্রতি ১০ হাজার টাকা যেত জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন এবং জেলা এসপি, সংশ্লিষ্ট থানার ওসি, থানা পুলিশ ও ডিবির পকেটে। এ ছাড়া নৌকাপ্রতি উত্তোলন করা হতো ১ হাজার টাকা। জেলা প্রশাসন ও থানা পুলিশের মধ্যে ৫ হাজার টাকা করে ভাগ হতো। এ ছাড়া নৌকাপ্রতি ৫০০ টাকা করে পেতেন তারা। আরও ভাগ পেতেন ইউএনও, এসিল্যান্ড ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের তহশিলদার। পুলিশের অংশের ভাগ পেতেন এসপি, সার্কেল এসপি, ওসি এবং কোম্পানীগঞ্জ থানার অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তা ও জেলা ডিবি কর্মকর্তারা। টাকা যেত বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট পিআইওতে। এ সংস্থাটিকে বলা হয় ‘পুলিশের চোখ ও কান’। সংস্থাটির কাজ হলো—পুলিশ সদস্যদের কার্যক্রম নজরদারি, দুর্নীতি ও অদক্ষতার তথ্য সংগ্রহ ও তদন্ত। এর মাধ্যমে, অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও বিশ্বস্ততা নিশ্চিত করা হয় এবং পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরীণ দুর্নীতিমুক্তকরণে সহায়তা করা হয়। তবে নিজেদের ভাগ ছাড়েননি এ সংস্থারও দুই সদস্য। তারা হলেন উপপরিদর্শক (এসআই) রানাকান্ত ও কনস্টেবল দেলোয়ার।

রাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি সংস্থা পাথর লুটপাটে জড়িতদের চিহ্নিত করেছে। এ রকম একাধিক প্রতিবেদন এসেছে কালবেলার হাতে। এসব প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাদাপাথর মূলত খনিজ সম্পদ। খনিজ সম্পদ সম্পর্কিত সব দায়দায়িত্ব খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর (বিএমডি) ওপর ন্যস্ত। তবে পাথর লুটপাটের ঘটনায় খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। সে হিসেবে সংস্থাটির দায়িত্বশীলরা পাথর লুটের অপরাধে দায়ী। এ ছাড়া বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী পাথর উত্তোলন বন্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেননি। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষার পরিবর্তে পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক ও রাজনৈতিক নেতাদের অবৈধ স্বার্থ রক্ষার অভিযোগ আনা হয়েছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে।

তদন্তে সিলেটের সাবেক ডিসি মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে। তার বিরুদ্ধে সদিচ্ছার অভাব, অবহেলা, ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তার প্রমাণ পেয়েছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। এ ছাড়া তার অধীন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে না পারাও লুটপাটের অন্যতম কারণ।

পাথর লুটপাটে সরাসরি চারজন ইউএনওর দায় মিলেছে অনুসন্ধানে। তাদের মধ্যে আছেন কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও আজিজুন্নাহার, যিনি দায়িত্ব পালন করেছেন চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি থেকে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত। আরও আছেন গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করা ইউএনও মোহাম্মদ আবুল হাসনাত; গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করা ঊমী রায় এবং গত বছরের ১১ জুলাই থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করা আবিদা সুলতানা।

একাধিক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব ইউএনও তাদের দায়িত্ব পালনকালে নামমাত্র ও লোক দেখানো কিছু ব্যবস্থা ছাড়া পাথর লুট বন্ধে তেমন কার্যকর ব্যবস্থা নেননি।

পুলিশ সুপারের দায়দায়িত্বে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন এবং পরিবহন বন্ধে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দিলেও সিলেটের এসপি মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান সাদাপাথর উত্তোলন বন্ধে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেননি। এসপির নিষ্ক্রিয়তা ও যোগসাজশের কারণে দুষ্কৃতকারীদের পক্ষে সাদাপাথর লুটপাট করা সম্ভব হয়েছে।

ওসির দায়দায়িত্বে বলা হয়েছে, কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে উজায়ের আল মাহমুদ আদনানসহ সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ অবৈধ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কমিশন নিয়ে পাথর লুটপাটে সহায়তা করেছেন। থানা পুলিশের নির্দিষ্ট সোর্স কখনো নিজেরাই এ চাঁদার টাকা উত্তোলন করতেন। অর্থ উত্তোলন ও সার্বক্ষণিক তদারকির দায়িত্ব পালন করেছেন কোম্পানীগঞ্জ থানার ছয়টি বিটের কর্মকর্তারা। এ ছাড়া এ লুটপাটে কোম্পানীগঞ্জ থানা ও গোয়াইনঘাট থানার প্রায় সব পুলিশ কর্মকর্তা কমিশন পেয়েছেন। পুলিশ প্রশাসনকে টাকা দেওয়া হতো তিনটি শর্তে। সেগুলো হলো—পাথরের ট্রাক না আটকানো, অভিযান না চালানো এবং অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনে বাধা প্রদান না করা।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সাদাপাথর উত্তোলনে বিজিবি সদস্যদেরও জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিজিবি সদস্যরা নৌকাপ্রতি ৫০০ টাকা করে উত্তোলন করতেন। জানতে চাইলে ৪৮ বিজিবি সিলেট ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল নাজমুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘আমি আমার সৈনিকদের বিষয়ে কনফিডেন্স। এ রকম কিছু ঘটেনি। যদি কেউ প্রমাণ দিতে পারে, তাহলে আমি ব্যবস্থা নেব।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিজিবি ৫০০ টাকা করে নিচ্ছে—এমন একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। সেটির বিষয়ে আমরা প্রতিবাদ দিয়েছি।’ ভিডিওর বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘আমরা টাস্কফোর্সের বাইরে অভিযান চালিয়ে শত শত বারকি নৌকা আটক করেছি। মাস দুয়েক আগে আমরা দুটি বারকি নৌকা আটক করি। তখন এখানকার নামধারী কয়েকজন সাংবাদিক ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা নৌকা ছেড়ে দিতে তদবির করেন। না ছাড়ায় তারাই কিছুক্ষণ পর এসে একটা ভিডিও বানিয়ে সেটা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেন।’

পাথর উত্তোলনে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামীর অন্তত ৩১ জনের সরাসরি সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে একাধিক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। বিএনপির জড়িত ব্যক্তিরা হলেন সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী, সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিন, সদস্য হাজি কামাল (পাথর ব্যবসায়ী), কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা শ্রমিক দলের সাবেক সভাপতি ও সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান লাল মিয়া, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন দুদু, সিলেট জেলা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক রুবেল আহমেদ বাহার, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মুসতাকিন আহমদ ফরহাদ, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক মো. দুলাল মিয়া দুলা, যুগ্ম আহ্বায়ক রজন মিয়া, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুবদল নেতা জসিম উদ্দিন, সাজন মিয়া, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির কর্মী জাকির হোসেন, মোজাফর আলী, মানিক মিয়া, সিলেট জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মকসুদ আহমদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম ওরফে শাহপরান, কোষাধ্যক্ষ (বহিষ্কৃত) শাহ আলম ওরফে স্বপন, সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কাশেম এবং পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আমজাদ বক্স।

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে জড়িতরা হলেন কোম্পানীগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবদুল ওদুদ আলফু, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের কর্মী বিলাল মিয়া, শাহাবুদ্দিন, গিয়াস উদ্দিন, মনির মিয়া, হাবিল মিয়া ও সাইদুর রহমান।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নতুন করিডোর প্রকল্প শুরু করতে চায় চীন-পাকিস্তান

থানা হাজতে যুবকের মৃত্যু, এএসআইসহ ৩ পুলিশ প্রত্যাহার

চবিতে নিলস-সিইউ পাবলিক স্পিকিং প্রতিযোগিতা শনিবার

জাতীয় সংখ্যালঘু সম্মেলন হয়নি, কারণ জানাল পুলিশ

বাদশার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবি মেয়র শাহাদাতের 

ঘুমাতে যাওয়ার কত আগে রাতের খাবার খাওয়া উচিত জেনে নিন

ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান ছাত্রসমাজ রুখে দেবে : আ স ম রব

চমেকে ১০ চর্ম রোগ নিয়ে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ 

বিভাজন তৈরির অপচেষ্টা চালানো হয়েছে : মাওলানা হালিম

আপনার শখের গাছের জন্য প্রাকৃতিক টনিক

১০

শিগগির শুরু হবে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সরাসরি ফ্লাইট : পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী 

১১

ইউক্রেনের আরও ৩ গ্রাম দখলের দাবি রাশিয়ার

১২

মিষ্টিমুখে অস্বাস্থ্যকর চিত্র, জরিমানা এক লাখ

১৩

‘মব’ করে তিন কিশোরকে বেঁধে বেধড়ক পিটুনি, নিহত ১

১৪

শিমুল বিশ্বাসের শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল, দেখতে গেলেন ডা. রফিক

১৫

আইফোন ব্যবহারকারীদের জন্য অ্যাপলের জরুরি সতর্কতা

১৬

এশিয়া কাপের জন্য বাংলাদেশের দল ঘোষণা

১৭

দেশকে বাঁচাতে পরিবেশ রক্ষা করতে হবে : মঈন খান

১৮

এশিয়া কাপের আগে বড় ঝামেলায় ভারত

১৯

গবেষণা / পুরুষদের তুলনায় নারীদের বেশি ঘুমের প্রয়োজন, জেনে নিন কেন

২০
X