

রাজশাহীর সিপাইপাড়া এলাকার এক শতাধিক বছরের পুরোনো রাজবাড়ি— যার দেয়ালে এখনো লেগে আছে রাজবংশের গৌরব, স্বাধীনতার ইতিহাস, নারীর অর্থনৈতিক মুক্তির কাহিনি। দিঘাপতিয়ার রাজবংশের রাজা হেমেন্দ্র নারায়ণ রায়ের ছেলে সন্দীপ কুমার রায়ের এ বাড়িটি ভাঙার কাজ অবশেষে বন্ধ করেছে প্রশাসন।
বুধবার (৩ ডিসেম্বর) দুপুরে বোয়ালিয়া থানা ভূমি কার্যালয়ের কর্মচারীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে ভাঙার কাজ স্থগিত করেন।
যদিও এর আগেই পাশাপাশি থাকা দুটি দোতলা ভবনের বেশির ভাগ অংশ মাটির সঙ্গে মিশে গেছে— রয়ে গেছে শুধু নিচের দিকে লুকিয়ে থাকা ইটের সুড়ঙ্গ, একসময়ের রাজকীয় নকশার নিঃশব্দ সাক্ষী।
বাড়িটির সামনে দাঁড়িয়ে দুপুরে হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি মাহবুব সিদ্দিকী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার ভাষায়, এই বাড়িটির বয়স প্রায় ১২০ বছর। এখন যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। অন্তত বাড়ির আঙিনার নাগলিঙ্গম গাছটি যেন না কাটা হয়— বিরল প্রজাতির এই গাছটি যেন নীরবে দাঁড়িয়ে আছে অতীতের পাহারাদার হয়ে। মাহবুব সিদ্দিকীর আক্ষেপ, প্রশাসনের কর্মকর্তারা সরেজমিনে না দেখেই বাড়িটি নিলাম দিয়েছেন। তারা একবার এলে হয়ত বুঝতে পারতেন— এটি কেবল একটি জরাজীর্ণ বাড়ি নয়, বরং রাজশাহীর ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বাড়ির নিচে থাকা কাঠামো নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলছেন এটি একটি সুড়ঙ্গ, আবার কারও মতে এটি প্রাচীন নির্মাণশৈলীর অংশ, যার মাধ্যমে বাড়ির নিচ দিয়ে বাতাস চলাচল করত। স্থানীয় কলেজশিক্ষক আকতার বানুর দাবি, পেছনের দোতলা ভবন থেকে সামনের একতলা অংশের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল এই পথটি— সম্ভবত নিরাপত্তার কথা ভেবেই এমন ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
রাজশাহীর কেন্দ্রীয় কারাগারের বিপরীতে, প্রধান সড়কের ধারে অবস্থিত এই রাজবাড়িটি বহু গল্পের ধারক। জনশ্রুতি আছে, পুঠিয়ার মহারানি হেমন্ত কুমারী রাজশাহী এলে এই দোতলা ভবনেই থাকতেন। রাজপরিবার চলে যাওয়ার পর বাড়িটি অনেক বছর পরিত্যক্ত ছিল। স্বাধীনতার পরে নতুন ইতিহাস রচিত হয় এখানে— ভাষাসৈনিক ও রাজশাহীর প্রথম নারী উদ্যোক্তা মনোয়ারা রহমান এখানে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মহিলা কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান’, যেখানে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রায় দশ হাজার নারী কর্মজীবী হওয়ার সুযোগ পায়। তার মৃত্যুর পর বাড়িটি আবারও নীরব হয়ে পড়ে।
সম্প্রতি বাড়িটির ইজারা বাতিল করে বোয়ালিয়া ভূমি কার্যালয় এবং পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকায় যুক্ত করে মাত্র ১ লাখ ৫২ হাজার টাকায় নিলামে বিক্রি করা হয়। নিলামপ্রাপ্ত ব্যক্তি শ্রমিক পাঠিয়ে দুই সপ্তাহ ধরে বাড়িটি ভাঙছিলেন— ইতিহাস ধুলায় মিশে যাচ্ছিল প্রতি আঘাতে।
বুধবার দুপুরে এলো নতুন সিদ্ধান্ত। জেলা প্রশাসনের নির্দেশে বোয়ালিয়া থানা ভূমি কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফ হোসেন লোক পাঠিয়ে ভাঙার কাজ বন্ধ করান এবং বাড়ির সামনে লালসালু টাঙিয়ে দেওয়া হয়। ভাঙা ইটগুলো নিলামপ্রাপ্ত ব্যক্তি সরিয়ে নিতে পারবেন, কিন্তু এরপর আর একটি ইটও তোলা যাবে না বলে জানানো হয়েছে। সবকিছু যাচাই-বাছাই না হওয়া পর্যন্ত বাড়িটি বর্তমান অবস্থায়ই থাকবে।
রাজশাহীর সিপাইপাড়ার এই বাড়িটি এখন অর্ধভাঙা দেয়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে— যেন সময়ের কাছে সাহায্য চাইছে টিকে থাকার জন্য। ইতিহাসের গন্ধ এখনো ভেসে বেড়ায় ভাঙা ইটের ফাঁকে, এখানে হয়তো এখনো শোনা যায় রাজাদের পদচারণা, মহারানির আগমন, কিংবা মনোয়ারা রহমানের হাতে গড়া নারীদের হাসিমুখের গল্প।
মন্তব্য করুন