দুটি অস্ত্র মামলার বিচার এড়াতে অভিনব জালিয়াতির ঘটনায় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগে মামলা করতে এবং এর সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জাল রায়ের ভিত্তিতে করা দুটি আপিল নিষ্পত্তি করে আজ বুধবার (২১ জুন) বিচারপতি ফাতেমা নজিব ও বিচারপতি ফাহমিদা কাদেরের বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
এই আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইন কর্মকর্তা সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সুলতানা নাসরিন সুইটি কালবেলাকে বলেন, আদালত এ জালিয়াতির ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারের জন্য শাহবাগ থানাকে নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া একটি মামলা করতে বলেছেন।
জানা যায়, দুটি অস্ত্র মামলার আসামি ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার ডুমাইন পশ্চিমপাড়া গ্রামের আবু বক্কর শেখের ছেলে মো. সাজ্জাদ শেখ। তার মামলা দুটি ফরিদপুরের আদালতে বিচারাধীন। কিন্তু অভিনব এক জালিয়াতির মাধ্যমে বিচার এড়ানোর চেষ্টা করেছেন তিনি। মামলা বিচারাধীন থাকলেও তার সাজা হয়েছে বলে জাল রায়ের অনুলিপি তৈরি করে হাইকোর্টে আপিল করেছেন।
হাইকোর্ট ওই আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করে বিচারিক আদালতের কাছে নথি তলব করে আদেশ দেন। একটি আপিল মামলার পরিপ্রেক্ষিতে নথি হাইকোর্টে পৌঁছালেও অন্য একটি মামলায় এসে জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়েছে। পরে বিষয়টি প্রধান বিচারপতির কাছে উত্থাপন করা হলে হাইকোর্টে বিচারাধীন দুটি আপিল মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির আদেশ দেন তিনি। আপিল মামলা দুটি নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টের বিচারপতি ফাতেমা নজিব ও বিচারপতি ফাহমিদা কাদেরের বেঞ্চে পাঠানো হয়। সে অনুযায়ী গতকাল এই আপিল মামলা দুটি (আপিল মামলা-৭৯৪২/২০১৬ ও ৭৫৪৪/২০১৮) নিষ্পত্তি করে এই জালিয়াতির ঘটনায় আইনিব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।
জানা যায়, ২০১৫ সালের ১০ এপ্রিল মধুখালী উপজেলার ডুমাইন পশ্চিমপাড়া গ্রামের মো. সাজ্জাদ শেখকে তার নিজ বাড়ি থেকে একটি বিদেশি রিভলভার এবং একটি শুটারগানসহ গ্রেপ্তার করে র্যাব। সংস্থাটি জানায়, সাজ্জাদ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী এবং দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় অস্ত্রের মুখে ভয়ভীতি দেখিয়ে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করে আসছে। পরে এ ব্যাপারে মধুখালী থানায় অস্ত্র আইনে মামলা হয়। এ মামলা ফরিদপুরের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন অবস্থায় সাজ্জাদ শেখ একটি জাল রায় তৈরি করেন।
ওই জাল রায়ে বলা হয়, আসামি অভিযোগ গঠনের সময় দোষ স্বীকার করেন। এজন্য তার সাজা কম হওয়া উচিত। তাকে ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইনের ১৯(এ) ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে সাত বছর এবং এফ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে তিন বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। দুটি সাজা একসঙ্গে চলবে বলে ওই রায়ে বলা হয়।
২০১৬ সালের ২৫ জুলাই ফরিদপুরের সিনিয়র দায়রা জজ মো. জাহিদুল ইসলাম ওই রায় দেন মর্মে রায়ের কপিতে উল্লেখ করা হয়। এই জাল রায়ের অনুলিপির ভিত্তিতে সাজ্জাদ শেখ হাইকোর্টে একটি আপিল করেন। আপিল মামলা নম্বর ৭৯৪২/২০১৬।
হাইকোর্টের নথি থেকে দেখা যায়, এই আপিল মামলাটি ২০১৮ সালের ২৯ আগস্ট শুনানির জন্য গ্রহণ করা হয়েছে। বিচারপতি মো. রইস উদ্দিনের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করে বিচারিক আদালতের নথি তলব করেন। তার পক্ষে আইনজীবী ছিলেন মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম। এরপর ২০১৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে এই অস্ত্র মামলার নথি তলব করে দেওয়া আদেশ পাঠানো হয়। সে অনুযায়ী এ মামলার নথি হাইকোর্টে পৌঁছায়।
এরই মধ্যে ২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মধুখালী থানায় আরও একটি অস্ত্র মামলা হয়েছে সাজ্জাদ শেখের বিরুদ্ধে। এ মামলাটি বর্তমানে ফরিদপুরের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-৩ এবং দ্বিতীয় অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। বিচারাধীন মামলা নম্বর ১৮/২০১৬। এই বিচারাধীন মামলায়ও তার সাজা হয়েছে এবং সে জেলে রয়েছে মর্মে একটি জাল রায় তৈরি করে আপিল করেন হাইকোর্টে। আপিল নম্বর ৭৫৪৪/২০১৮।
২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করে মামলার নথি তলব করেন। হাইকোর্টের এই আদেশের কপি ফরিদপুরের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-৩ এবং দ্বিতীয় অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে পৌঁছালে ওই আদালতের বিচারক কামরুন্নাহার বেগম ২০১৯ সালের ২৮ এপ্রিল একটি আদেশ দেন।
সেই আদেশে তিনি লেখেন, হাইকোর্ট বিভাগের ওই আদেশ মোতাবেক দেখা যায়, মামলাটি ২০১৮ সালের ২১ জুন রায়ের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে অত্র মামলাটি মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের ক্রিমিনাল আপিল নং-৭৫৪৪/২০১৮ এর প্রয়োজনে নথি তলব করা হয়েছে। আদেশ অনুযায়ী আসামি সাজ্জাদ শেখের বিরুদ্ধে অত্র মামলায় সাজা প্রদান করা হয়েছে এবং সেই মোতাবেক আসামি সাজা ভোগের নিমিত্ত জেলহাজতে আটক রয়েছেন।
অত্র মামলার নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, মামলাটি এখনো বিচারাধীন। ২০১৮ সালের ২১ জুন নিষ্পত্তি হয়নি। এমনকি ওই তারিখে অত্র মামলা সংশ্লিষ্টে কোনো আদেশও হয়নি। আসামি সাজ্জাদ শেখকে অত্র মামলায় কোনো সাজা প্রদানও করা হয়নি। মামলাটি বর্তমানে সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে এবং আগামী ২১/০৫/২০১৯ তারিখ প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ধার্য আছে। মামলার একমাত্র আসামি সাজ্জাদ শেখ অত্র মামলায় এর আগে জামিনপ্রাপ্ত হয়ে বর্তমানে পলাতক অবস্থায় আছেন। যেহেতু মামলাটি নিষ্পত্তি হয়নি এবং বিচারাধীন রয়েছে, সেহেতু ওই মামলাটি নিষ্পত্তি দেখিয়ে পলাতক আসামি কর্তৃক মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে দায়েরকৃত ক্রিমিনাল আপিল নং-৭৫৪৪/২০১৮ এর প্রয়োজনে তলবকৃত অত্র বিশেষ ট্রাইব্যুনাল কেস নং-১৮/২০১৬ এর নথি প্রেরণ করা সম্ভব হলো না।’
এরপর এই আদেশসহ একটি চিঠি ২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনকে পাঠান ফরিদপুরের জেলা জজ। কিন্তু তৎকালীন রেজিস্ট্রার জেনারেল অফিস থেকে বিষয়টি ভুলবশত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এ অবস্থায় মামলাটি বিচারিক আদালতে পড়ে থাকে। সম্প্রতি ফরিদপুরের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-৩ এবং দ্বিতীয় অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতের নতুন বিচারক এসে এই অস্ত্র মামলার রায় প্রদানকালে ফের জালিয়াতির বিষয়টি লক্ষ্য করেন। তিনি ফের জালিয়ারিত বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনকে অবহিত করেন। এর পরই সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন এই জাল-জালিয়াতির বিষয়ে পদক্ষেপ নেন।
মন্তব্য করুন