রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করতে ও নেতৃত্ব দিতে গড়ে ওঠা ১৭ সদস্যের সমন্বয়ক পরিষদ ভাগ হয়ে গেলেন ছাত্র সংসদ নির্বাচনে। জুলাই আন্দোলনের পর এই সমন্বয়করা ক্যাম্পাসে হয়ে উঠেছিলেন পরিচিত মুখ। তাই রাকসু নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে জোর আলোচনা ছিল— তারা কি একজোট হয়ে একক প্যানেল করবেন, নাকি স্বতন্ত্র প্রার্থী? তবে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিচয়সহ নানা জটিলতায় ঐক্য ভাগ হয়ে গেলেন বিভিন্ন প্যানেলে।
দেখা গেছে, ১৭ সমন্বয়কের মধ্যে ১০ জন তুলেছেন মনোনয়নপত্র। তাদের একজন হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আর বাকিরা যুক্ত হয়েছেন বিভিন্ন প্যানেলে। এ পর্যন্ত আত্মপ্রকাশ করা ৯টি প্যানেলের ৫টিতে পাওয়া গেছে তাদের উপস্থিতি। কেউ ভিপি, কেউ জিএস, কেউবা এজিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সমন্বয়কদের মধ্যে পাঁচজনের ছাত্রত্ব শেষ হওয়ায় প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পাননি। আবার দুজন নারী সমন্বয়ক প্রার্থী হওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সাইবার বুলিংয়ের আতঙ্কে সরে দাঁড়িয়েছেন।
সমন্বয়করা যেসব প্যানেল থেকে নির্বাচন করছেন তাদের সেই প্যানেলভিত্তিক চিত্রও বেশ বৈচিত্র্যময়। ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’ -এর জিএস পদে লড়ছেন সমন্বয়ক ফজলে রাব্বি মো. ফাহিম রেজা। তিন সমন্বয়কের উদ্যোগে গঠিত ‘আধিপত্যবিরোধী ঐক্য’ প্যানেলে ভিপি প্রার্থী হয়েছেন মেহেদী সজীব, জিএস সালাউদ্দিন আম্মার, এজিএস আকিল বিন তালেব।
‘সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেলে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তাসিন খান, এজিএস পদে মাহাইর ইসলাম। ‘রাকসু ফর রেডিক্যাল চেঞ্জ’ প্যানেলে ভিপি পদে মাঠে নেমেছেন ছাত্র অধিকারের পরিষদের সভাপতি মেহেদী মারুফ। আর ‘গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদ’ প্যানেল থেকে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের আহ্বায়ক ও সমন্বয়ক ফুয়াদ রাতুল।
অন্যদিকে মো. আতাউল্লাহ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন পরিবেশ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক পদে। নুরুল ইসলাম (শহিদ) যুক্ত হয়েছেন নবাব আব্দুল লতিফ হলের শিবির সমর্থিত ‘নবাবীয়ান ঐক্যজোট’-এর সঙ্গে এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন জিএস পদে। ছাত্রত্ব না থাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাইরে রয়েছেন মেহেদী হাসান (মুন্না), গোলাম কিবরিয়া মিশকাত চৌধুরী, মাসুদ রানা, মো. নওসাজ্জামান ও তানভীর আহমেদ রিদম।
সমন্বয়কদের ভাঙনের মূল কারণ হিসেবে সামনে এসেছে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা। আন্দোলনের সময় যারা ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’ পরিচয়ে ছিলেন, তাদের অনেকেই পরে শিবিরের হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাই নানা গুঞ্জন— সমন্বয়করা আসলে কারও ‘এ টিম’, কারও ‘বি টিম’। গুঞ্জন আরও জোরালো হয় যখন ফজলে রাব্বি শিবির সমর্থিত প্যানেলের জিএস প্রার্থী হিসেবে নাম ঘোষণা করেন।
এ বিষয়ে ফজলে রাব্বি বলেন, ‘আমি প্রথমে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চেয়েছিলাম। পরে ইসলামী ছাত্রশিবির ইনক্লুসিভ প্যানেল করার উদ্যোগ নিলে আলোচনার মাধ্যমে আমি তাদের সঙ্গে যুক্ত হই। দীর্ঘদিন সংগ্রাম করে শিবির সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রবান্ধব রাজনীতি করার চেষ্টা করেছে। সেই জায়গা থেকেই যুক্ত হয়েছি।’
অন্যদিকে মেহেদী সজীব বলেন, ‘ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগরে আমাদের মতো সমন্বয়করা গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদে যুক্ত হয়ে সংগঠিতভাবে কাজ করছেন। রাজশাহীতে এমন কাঠামো না থাকায় আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করেছি। চেষ্টা হয়েছিল সবাইকে এক করার; কিন্তু হয়নি।’
সমন্বয়ক ও একমাত্র নারী ভিপি প্রার্থী তাসিন খান বলেন, ‘রাকসু নিয়ে আমাদের ভাবনায় পার্থক্য আছে ঠিকই; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে আমরা আবারও একত্র হবো।’
তবে এবারের নির্বাচনে অনুপস্থিতি চোখে পড়ার মতো দুজন নারী সমন্বয়কের। ফৌজিয়া নৌরিন অভিযোগ করেছেন, জুলাই আন্দোলনের পর তিনি একাধিকবার সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন। তার ভাষায়, ‘এত বেশি বুলিংয়ের শিকার হয়েছি, মানসিক ভারসাম্য রাখা কঠিন হয়ে গিয়েছিল। বাজে মন্তব্য ও আক্রমণে নারী হিসেবে গভীরভাবে আঘাত পেয়েছি। নির্বাচনে নামলে একই পরিস্থিতি তৈরি হতো। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারেনি।’
অহনা মৃত্তিকার কথায় হতাশা আরও স্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীরা সামনের সারিতে ছিল। কিন্তু পরে আর কেউ আমাদের পাশে থাকেনি, মনে রাখেনি। বরং নানা ধরনের বুলিং শুরু হয়। এতে কাজ করার মনোভাব হারিয়ে ফেলেছি। পরিবেশও অনুকূলে নয়।’
মন্তব্য করুন