বাসস
প্রকাশ : ০৯ মে ২০২৫, ০৩:৫০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

বিয়ের পিঁড়িতে বসা হলো না শহীদ সুজন মাহমুদের

সুজন মাহমুদ। ছবি : সংগৃহীত
সুজন মাহমুদ। ছবি : সংগৃহীত

স্বপ্ন ছিল ঘর বাঁধবেন, নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানে নতুন জীবন শুরু করবেন, কিন্তু তার আগেই রক্তাক্ত হলো সে স্বপ্ন। ৫ আগস্ট ঢাকার রাজপথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন তরুণ প্রকৌশলী সুজন মাহমুদ। একটি সম্ভাবনাময় জীবনের হঠাৎ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাওয়া যেন এ সময়ের এক নির্মম বাস্তবতা।

স্বৈরাচার পতনের পর গণমানুষের স্বপ্নময় উদ্দীপনায় যখন রাজপথ মুখর, তখনই ক্ষমতাদর্পী স্বৈরশাসকের ঘাতক বুলেট এক নিষ্পাপ প্রাণের স্বাপ্নিক অভিযাত্রার রাশ টেনে ধরে।

ক’দিন পরই বিয়ের পিঁড়িতে বসার কথা ছিল যে যুবকের, কথা ছিল ফুলশয্যার মায়াবী আবহে বিভোর হয়ে নতুন স্বপ্ন বোনার, তার ঠিকানা রচিত হলো কবরের নিকষ আঁধারে।

শহীদ সুজনের গল্প শুধু একজন তরুণের ট্র্যাজেডি নয়, এটি একটি প্রজন্মের লড়াই ও বিসর্জনের মন কেমন করা এক বিষাদগাথা।

২০২৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বিয়ের তারিখ নির্ধারিত ছিল তরুণ প্রকৌশলী সুজন মাহমুদের (৩৪)। কিন্তু তার আগেই, ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর বিজয় মিছিলে অংশ নিয়ে রাজধানী ঢাকার মিরপুরে পুলিশ ও ছাত্র-জনতার সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন তিনি। ফলে বিয়ের পিঁড়িতে আর বসা হয়নি তার। অনেক স্বপ্ন বুকে নিয়ে অকালেই ঝরে গেল একটি তাজা প্রাণ।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী শহীদ সুজন মাহমুদের বড় বোন রাবেয়া খাতুন সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার পৌরসদরের রূপপুর নতুনপাড়া মহল্লার নিজ বাসভবনে গণমাধ্যমকে এসব কথা জানান। এ সময় সুজনের মা শামছুন্নাহার বেগম এবং মেঝো ভাই সুলতান মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন।

শহীদ সুজনের বোন রাবেয়া খাতুন বলেন, “কী দোষ ছিল আমার ভাইয়ের? তাকে কেন নিষ্ঠুরভাবে গুলি করে হত্যা করা হলো?’ তিনি বলেন, ‘৫ আগস্ট বিকেল চারটার দিকে আমার সঙ্গে কথা হয়। সুজন নিজেই ফোন করেছিল। হয়তো শেষ কথাগুলো বলার জন্যই। ভাবতেও পারিনি, ওর সঙ্গে এটাই হবে শেষ কথা।

আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, দুপুরে কী দিয়ে ভাত খেয়েছ? ভাই বলেছিল, গরুর মাংস দিয়ে খেয়েছে। আমি বলেছিলাম, তুমি আজ মিছিলে যেও না। সে বলেছিল, ‘আজ আর কোনো সমস্যা নেই। শেখ হাসিনা তো পালিয়ে গেছে। পুলিশ আর গুলি করবে না।’ কিন্তু বিকেল পাঁচটার দিকে ওর বন্ধুরা ফোন করে জানায়, সুজন আর নেই।”

সুজনের শোকে স্তব্ধ মা শামছুন্নাহার বেগম (৬৫) বলেন, ‘আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দাও। কী দোষ ছিল আমার ছেলেটার? সে তো কোনো অন্যায় করেনি। তাহলে কেন এভাবে তার প্রাণ কেড়ে নেওয়া হলো? আমি আমার সন্তানের হত্যার বিচার চাই।’

শহীদ সুজন মাহমুদ সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার রূপপুরে ১৯৯১ সালের ৩০ জুন জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রূপপুর নতুনপাড়া মহল্লার মৃত আলহাজ আবদুর রশিদ মাস্টারের ছোট ছেলে।

তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন সুজন মাহমুদ। ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি শেষ করে কিছুদিন চাকরি করার পর নিজস্ব ব্যবসা শুরু করেন। থাকতেন মিরপুর-৬ নম্বরে ভাড়া বাসায়। ২০২৪ সালের কোরবানির ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসে মা, ভাই ও বোনের সঙ্গে কাটিয়েছিলেন কিছুদিন। কিন্তু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মায়ের সঙ্গে আর দেখা হয়নি।

মেঝো ভাই স্কুলশিক্ষক সুলতান মাহমুদ বলেন, বিএসসি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে সুজন ঢাকার একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করত। পরে নিজের ব্যবসা শুরু করে।

৫ আগস্ট বিকেলে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়ে মিরপুর-২ নম্বর এলাকায় গেলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। গুরুতর আহত অবস্থায় প্রথমে তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

তিনি আরও বলেন, রাত ২টা ৩০ মিনিটের দিকে তার লাশ শাহজাদপুর উপজেলার হাবিবুল্লাহনগর ইউনিয়নের রতনকান্দি গ্রামের বাড়িতে আনা হয়। ৬ আগস্ট সকাল ৯টায় বাদলবাড়ি শাহ হাবিবুল্লাহ (রহ.)-এর মাজার প্রাঙ্গণে জানাজা শেষে হাবিবুল্লাহ ইয়েমেনি মাজার কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

শহীদ সুজনের বড় ভাই শাহীন উদ্দিন বলেন, ‘আমি আমার ভাই হত্যার বিচার চাই। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত খুনিকে খুঁজে বের করে তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে।’

পরিবারের সদস্যরা জানান, শহীদ সুজন মাহমুদ রাজধানী ঢাকায় ‘ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি বিডি’ নামের নিজের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। প্রতিষ্ঠানটি থেকে ইলেকট্রনিক্স পণ্য অনলাইনে বিক্রি করতেন তিনি।

শহীদ সুজন মাহমুদ দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনের দিন অর্থাৎ ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে অংশ নেন। মিছিলটি মিরপুর-১০ নম্বর থেকে মিরপুর-৬ নম্বরের দিকে যাওয়ার সময় বিকেল আনুমানিক সাড়ে ৪টার দিকে মিরপুর মডেল থানা থেকে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে।

তখন মানুষজন বিভিন্ন দিকে ছোটাছুটি শুরু করে। ঠিক তখনই একটি গুলি সুজন মাহমুদের ঘাড়ে বিদ্ধ হয়। প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে এবং পরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

শহীদ সুজনের মা শামছুন্নাহার বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়। মৃত্যুভয় তাকে আন্দোলন থেকে বিরত রাখতে পারেনি। সুজনের স্বপ্ন ছিল বড় ব্যবসায়ী হওয়ার। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর বাস্তবায়ন হলো না। সে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার কলিজার টুকরো ছেলেকে পুলিশ নির্মমভাবে হত্যা করেছে। সবাই আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন।’

সহযোগিতার বিষয়ে জানতে চাইলে ভাই সুলতান মাহমুদ বলেন, ‘জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকার চেক এবং জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা পেয়েছি। এছাড়াও জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঈদের আগে আমাদের সঙ্গে দেখা করেছেন এবং পরিবারের খোঁজখবর নিয়েছেন।’

সুজন মাহমুদ হত্যার ঘটনায় ২০ সেপ্টেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে রাজধানীর সিএমএম কোর্টে হত্যা মামলা করা হয়। শহীদ সুজনের মেঝো ভাই সুলতান মাহমুদ বাদী হয়ে মামলাটি করেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মাথায় গুলি ঠেকিয়ে প্রকাশ্যে বিপুল টাকা ছিনতাই

কমেছে স্বর্ণের দাম, কত টাকা ভরি আজ

স্ত্রী অল্পতেই রাগছেন? জেনে নিন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ 

টাঙ্গুয়ার হাওরে ৫ পর্যটকের কারাদণ্ড

৪ স্কুলছাত্রীকে আটকে রেখে ধর্ষণের অভিযোগে শিক্ষক গ্রেপ্তার

রোজা কবে শুরু হতে পারে, জানাল আমিরাত

‘মহান এই নায়ককে ক্ষমা করে দেওয়া উচিত’

ঢাকায় হালকা বৃষ্টির আভাস

পুকুরে দেখা মিলল কুমিরের

শিক্ষকের ভুলে পরীক্ষা দেওয়া হলো না দুই শিক্ষার্থীর

১০

সন্ধ্যায় জানা যাবে পবিত্র আশুরার ছুটি কবে

১১

যুক্তরাজ্যের এফ-৩৫বি যুদ্ধবিমান ভারতে

১২

বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাসহ চাকরি দিচ্ছে আকিজ গ্রুপ

১৩

সন্তান কান্না করায় গলা কাটলেন পাষণ্ড বাবা

১৪

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের সর্বশেষ ঘটনাবলি

১৫

ফেসবুকে প্রেমিকাকে ভালোবাসি লিখে ছাদ থেকে শিক্ষার্থীর লাফ

১৬

এইচএসসি পরীক্ষা আজ, অংশ নিচ্ছেন ১২ লাখ শিক্ষার্থী

১৭

২৬ জুন : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৮

গাজায় ইসরায়েলের ভয়াবহতা আরও বাড়ছে

১৯

বৃহস্পতিবার ঢাকার যেসব এলাকায় মার্কেট বন্ধ

২০
X