বাসস
প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০২৫, ১০:২১ এএম
অনলাইন সংস্করণ
ফিরে দেখা ১৮ জুলাই

‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘিরে ব্যাপক সংঘর্ষ, নিহত ৩১

আজমপুরে শাহাদতের আগে পানি বিলি করেন মুগ্ধ, একইদিনে হানিফ ফ্লাইওভারে ছাত্রলীগের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের তুমুল সংঘর্ষ। ছবি : বাসস থেকে নেওয়া
আজমপুরে শাহাদতের আগে পানি বিলি করেন মুগ্ধ, একইদিনে হানিফ ফ্লাইওভারে ছাত্রলীগের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের তুমুল সংঘর্ষ। ছবি : বাসস থেকে নেওয়া

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ ছিল প্রায় অচল। এদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষে সাংবাদিকসহ অন্তত ৩১ জন নিহত হন।

তাদের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় ২৪ জন, চট্টগ্রামে ও নরসিংদীতে দুজন করে এবং রংপুর, সাভার ও মাদারীপুরে একজন করে নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ১১ জন শিক্ষার্থী ছিলেন। এদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে আহত হন প্রায় দেড় হাজার মানুষ। এর আগে ১৬ জুলাই আন্দোলনে সারা দেশে ছয়জন নিহত হন। এ নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদের সংখ্যা ৩৭ জনে পৌঁছায়।

১৮ জুলাই সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচির দিনে রাজধানীর রামপুরায় বিটিভি ভবন এবং মহাখালীতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, ডাটা সেন্টার ও সেতু ভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে বিটিভির সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া মিরপুর, মহাখালী, বাড্ডাসহ আরও কয়েকটি এলাকায় পুলিশ বক্সে আগুন ও ভাঙচুর করে আন্দোলনকারীরা। উত্তরা-পূর্ব থানায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্বঘোষিত ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এদিন ঢাকাসহ সারা দেশে ২২৯ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়। এছাড়া ডিএমপি অনির্দিষ্টকালের জন্য রাজধানীতে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

এদিন বেলা ১২টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ঢাকার সঙ্গে দেশের অধিকাংশ জেলার রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। রাত ৯টার পর থেকে ইন্টারনেট সেবা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

১৮ জুলাই বেলা সাড়ে ১২টার দিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজায় আগুন দেয় আন্দোলনকারীরা। যাত্রাবাড়ী ও কাজলায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ রাজধানীর অনেক এলাকার সড়ক অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা।

এদিকে মেট্রো লাইনের নিচে মিরপুর-১০ গোলচত্বরে ফুটওভার ব্রিজে পুলিশ বক্সে আগুন দেওয়া হয়। পরে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ।

‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি চলাকালে রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি সরকার। শিক্ষার্থীর সঙ্গে আলোচনার জন্য আমাকে ও শিক্ষামন্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।’

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরকারের আলোচনা প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়ায় ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, ‘গুলির সঙ্গে কোনো সংলাপ হয় না। এই রক্তের সঙ্গে বেইমানি করার থেকে আমার মৃত্যু শ্রেয়।’

সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসবে না জানিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সহিংসতা চালিয়ে সরকার উদ্ভূত পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এর দায় সরকারেরই। শহীদের রক্তের ওপর কোনো সংলাপ হবে না। সরকারকেই সমাধানের পথ বের করতে হবে।

পরের দিন শুক্রবার (১৯ জুলাই) সারা দেশে শাটডাউন কর্মসূচি অব্যাহত রাখা এবং জুমার নামাজের পর গায়েবানা জানাজার কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন নাহিদ ইসলাম।

এদিন সন্ধ্যায় সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিলের শুনানির জন্য রোববার (২১ জুলাই) দিন ধার্য করে চেম্বার আদালত। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে ওই দিন এ বিষয়ে শুনানি হবে।

রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ নিহত হওয়ার ঘটনায় ১৮ জুলাই পুলিশের পক্ষ থেকে ৪ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

এদিন উত্তরায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সাথে পুলিশ ও র‌্যাবের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড বোমা ও রাবার বুলেট ছোড়ে। দিনভর থেমে থেমে সংঘর্ষ চলে। দুপুরে আন্দোলনকারীরা উত্তরা-পূর্ব থানায় আগুন দেন।

এছাড়াও রাজধানীর মেরুল বাড্ডা, রামপুরা, মালিবাগ, ধানমন্ডি, মিরপুর-১০, নীলক্ষেত, আজিমপুর, তেজগাঁও, শান্তিনগর, মহাখালী, শনির আখড়া, কাজলা, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। দিনভর এসব এলাকা ছিল রণক্ষেত্রের মতো। শিক্ষার্থীদের ধাওয়ায় মেরুল বাড্ডায় কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটিতে আশ্রয় নেন পুলিশের সদস্যরা। বিকেলে তাদের হেলিকপ্টারে করে উদ্ধার করা হয়। এদিন দেশের ৪৭ জেলায় পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়।

ফায়ার সার্ভিস জানায়, বুধবার ও বৃহস্পতিবারের সহিংসতায় সারা দেশে ২৫টি স্থানে আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরীতেই ১৫টি। এছাড়া ছয়টি বাস, দুটি মাইক্রোবাস, ২০টি মোটরসাইকেল, সরকারি অফিস, রাজনৈতিক দলের কার্যালয়, টোল প্লাজা ও থানাসহ অনেক পুলিশ বক্স ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে ছয়জন নিহত এবং সাম্প্রতিক সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়।

এদিন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের শতাধিক নেতা-কর্মী পদত্যাগ করেন। এছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় ছাত্রলীগের ২৪ জন নেতা-কর্মী দল থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন।

ওই সময় কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেন, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করা মৌলিক মানবাধিকার। বাংলাদেশ সরকারের উচিত মানুষের এ অধিকার নিশ্চিত করা।

ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক বলেন, ‘পরিস্থিতি বুঝেই ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছে।’

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াতের প্রশিক্ষিত ক্যাডার বাহিনী সারা দেশে এই তাণ্ডব চালাচ্ছে। তাদের উসকানির জন্য সারা দেশে কয়েকজনকে প্রাণ দিতে হয়েছে।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চেপে বসেছে বিএনপি-জামায়াত। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আন্দোলন ছিনতাই করেছে তারা।’

এদিন যশোরের কেশবপুরে যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়ক, রাজবাড়ীতে রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া ও রাজবাড়ী-ফরিদপুর আঞ্চলিক মহাসড়ক, ঝালকাঠির রাজাপুরে খুলনা-বরিশাল মহাসড়ক, গাজীপুরের শ্রীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, বরিশালে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।

এছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়ক, পঞ্চগড় শহরে ঢাকা-পঞ্চগড় মহাসড়ক এবং কক্সবাজারে চট্টগ্রাম- কক্সবাজার ও কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক এবং রাঙামাটি ও লক্ষ্মীপুর শহরে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ে আন্তর্জাতিক গবেষণার ফলাফল

গুগল সার্চে বড় পরিবর্তন, যুক্ত হলো একাধিক নতুন ফিচার

ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন থাকার আহ্বান আমিনুলের

পিরিয়ড নিয়ে লজ্জা নয়, জ্ঞান থাকুক

এবার রণবীরের নায়িকা হচ্ছেন শ্রীলীলা

‘চোখের নিচের তিলই পার্থক্য ছিল মুগ্ধ-স্নিগ্ধের’

গোপালগঞ্জে সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা, আসামি ৪৭৫

সন্ধ্যার মধ্যে যেসব জেলায় হতে পারে ঝড়

নারায়ণগঞ্জে এনসিপির তোরণে আগুন

দুই প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন তুলছেন এক শিক্ষক! 

১০

আসিফ মাহমুদ / ‘যতদিন বাংলাদেশের নাম থাকবে, ততদিন উচ্চারিত হবে জুলাই যোদ্ধাদের নাম’

১১

নির্বাচনী জনসভায় ভাষণ দিতে পশ্চিমবঙ্গে মোদি

১২

২০২৬ বিশ্বকাপেই পেনাল্টি নিয়মে আসছে বড় পরিবর্তন!

১৩

ব্র্যাক ব্যাংকে চাকরির সুযোগ, আবেদন করুন আজই

১৪

হানিয়ার নতুন রেকর্ড

১৫

বিএনপি নেতা সাবেক এমপি মান্নান তালুকদার মারা গেছেন

১৬

ঋতুপর্ণা-সাবিনার ডাবল হ্যাটট্রিকে ভুটানে ২২ গোলের ‘ঝড়’

১৭

আকর্ষণীয় বেতনে নিয়োগ দিচ্ছে এসকেএফ ফার্মা

১৮

শিক্ষক নিয়োগের ফলাফল এক যুগেও প্রকাশ করেনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

১৯

ভিনির জন্য পেট্রো ডলার নিয়ে প্রস্তুত সৌদি ক্লাব

২০
X