কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৩, ০৩:৪৭ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

নির্বাচনের আগে ও পরে ভয়ে থাকে সংখ্যালঘুরা : রানা দাশগুপ্ত

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের ঢাকা বিভাগীয় প্রতিনিধি সভায় অতিথিরা। ছবি : কালবেলা
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের ঢাকা বিভাগীয় প্রতিনিধি সভায় অতিথিরা। ছবি : কালবেলা

আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক মাত্রায় সংখ্যালঘু নির্যাতনের আশঙ্কা প্রকাশ করে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, অতীতে যে কোনো নির্বাচনের পূর্বাপর সময়ে সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে একটি বিশেষ মহল দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়। তাদের লক্ষ্য একটাই, দেশটাকে সংখ্যালঘুশূন্য করা।

শনিবার (২৪ জুন) সকালে রাজধানীর বিএমএ মিলনায়তনে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের ঢাকা বিভাগীয় প্রতিনিধি সভায় অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত এ কথা বলেন।

সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, সংখ্যালঘুবিষয়ক জাতীয় কমিশন গঠন, দেবোত্তর সম্পত্তি আইন প্রণয়ন, বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন, পার্বত্য শান্তিচুক্তি ও পার্বত্য ভূমি কমিশন যথাযথ বাস্তবায়ন, সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনসহ সরকারি দলের বিগত নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুত সংখ্যালঘু স্বার্থবান্ধব অঙ্গীকারসমূহ বাস্তবায়নের দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই প্রতিনিধি সভা আয়োজন করা হয়।

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সংখ্যালঘুদের অবস্থা কী দাঁড়াবে, তা নিয়ে উদ্বেগ ও শঙ্কা প্রকাশ করে রানা দাশগুপ্ত বলেন, আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেও এই আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে তাকে বলেছি, নির্বাচনের আগে আমাদের বড় ভয় হয়। কারণ, নির্বাচন এলেই বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের খেলার ঘুঁটি বানানো হয়। এ অবস্থা রোধ করতে হলে অবশ্যই সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও সংখ্যালঘুবিষয়ক জাতীয় কমিশন গঠনসহ সাত দফা দাবি দফা বাস্তবায়ন করতে হবে।

তিনি বলেন, এই সাত দফা কেবল আমাদের দাবি নয়, বরং আমাদের দাবিকে আমলে নিয়ে বিগত নির্বাচনের আগে সরকারি দল আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে এই দাবিগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছিল। তাই এই সাত দফা এখন সরকারি দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। এগুলো বাস্তবায়ন সরকারের রাজনৈতিক দায়িত্ব। এই দাবিতে আমরা একাধারে আলোচনা ও আন্দোলন অব্যাহত রাখব।

প্রতিনিধি সভায় অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে লেখা ছয় কংগ্রেসম্যানের চিঠির প্রসঙ্গে বলেন, ছয় কংগ্রেসম্যানের চিঠিতে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু কেবল আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে যে কথা বলা হয়েছে, তা ঠিক নয়। বরং পাকিস্তান আমল থেকেই এ দেশে সংখ্যালঘু নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়া চলে এসেছে। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে সংখ্যালঘু সংকোচন নীতি গ্রহণ করেছিল। একে বলা চলে ‘ইথনিক ক্লিনজিং প্রসেস’। আমরা আশা করেছিলাম, স্বাধীন বাংলাদেশে এই প্রসেস থেকে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সরকারি ও বেসরকারি লেবাসে বাংলাদেশকে আবারও পাকিস্তানি ধারায় নিয়ে যাওয়ার তৎপরতা শুরু হয়।

তিনি বলেন, ১৯৭৭ সালে সামরিক ফরমান বলে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে সাম্প্রদায়িক সংবিধানে পরিণত করা হয়। ১৯৮৮ সালে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আড়াই কোটি মানুষকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হয় এবং পাকিস্তানি সংখ্যালঘু সংকোচন নীতিকে খন্দকার মোশতাক, জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ এগিয়ে নিয়ে যায়। এই অপতৎপরতা থেকে আমরা এখনো মুক্তি পাইনি। সংবিধান এখনো ধর্মনিরপেক্ষ হয়নি, আমরা এখনো রাষ্ট্রধর্ম থেকে মুক্তি পাইনি। বরং সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে সামরিক শাসকের করা রাষ্ট্রধর্মের বিধানকে সংবিধানে পাকাপোক্ত রূপ দেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্টের সংবাদ সম্মেলনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে রানা দাশগুপ্ত বলেন, ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে একটানা সংখ্যালঘু নির্যাতন চালানো হয়েছে। ওই ঘটনায় বর্তমান রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে সাহাবুদ্দীন কমিশন বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে। ওই তদন্ত কমিটির কাছে আমরা ৫৮ হাজার ঘটনার তথ্য-উপাত্ত দিয়েছি। ২০১১ সালে ওই কমিশন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের কাছে তদন্ত রিপোর্ট পেশ করে। রিপোর্টে উল্লিখিত হয়েছিল, বিএনপি ও জামায়াতের কোন কোন নেতা কোথায় কীভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতন-নিপীড়ন করেছিল। সাহারা খাতুনের কাছে আমরা বারবার বলেছি, ওই রিপোর্টের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে। পরে মহিউদ্দীন খান আলমগীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলে তার কাছেও আমরা বারবার ধরনা দিয়েছি। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছেও বারবার বলেছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। কল্যাণ ফ্রন্টের সংবাদ সম্মেলনে একপক্ষীয়ভাবে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে কেবল আওয়ামী লীগ আমলের ১৩ বছরের সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট আমলের নির্যাতন-নিপীড়নের কথা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তাই তাদের বক্তব্য রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড় সংগঠন নয়, নিরপেক্ষভাবেই আমরা সকল সরকারের আমলের সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাবলি তুলে ধরে সমঅধিকার ও সমমর্যাদা রক্ষার লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি।

অধ্যাপক আবুল বারকাতের সংখ্যালঘুবিষয়ক গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরে রানা দাশগুপ্ত বলেন, চলমান সংখ্যালঘু নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে আগামী দুই দশক পরে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী খুঁজে পাওয়া যাবে না।

সাহাবুদ্দীন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, আসুন, সামনের ঈদের সময় আমরা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে যাই। তার কাছে নির্বাচনের আগে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের শঙ্কার কথা তুলে ধরি। আসুন, আমরা সাহাবুদ্দীন কমিশনের রিপোর্টের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রপতিকে বলি। তিনি যাতে প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে। আসুন, আমরা রাষ্ট্রপতিকে বলি, আপনার দেওয়া সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি। আজকে আপনি রাষ্ট্রপতি। আপনার দেওয়া সুপারিশ আপনিই বাস্তবায়ন করেন।

তিনি একই সঙ্গে বিদেশি রাষ্ট্রের দূতাবাস ও হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের কাছেও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের উদ্বেগ ও আশঙ্কার কথা তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এই শঙ্কার কথা আমরা ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেছি। অন্যান্য রাজনৈতিক দলকেও ডেকে আমাদের শঙ্কার কথা বলব।

উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সম্পর্কে সতর্ক করে রানা দাশগুপ্ত বলেন, একটি স্বার্থান্বেষী মহল দেশকে আফগানিস্তান, ইরাক, সোমালিয়ার দিকে নিয়ে যাওয়ার পাঁয়তারা করছে। তারা দেশকে সংখ্যালঘুশূন্য করতে চায়। বাংলাদেশ সোমালিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক হয়ে যাক, তা কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিক মেনে নিতে পারে না। তিনি সব রাজনৈতিক দলকে ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’ এই স্লোগানের সঙ্গে ‘ধর্মীয় রাষ্ট্র নয়, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র চাই’—এই লাইনটি যুক্ত করার আহ্বান জানান।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ও ঢাকা বিভাগীয় প্রতিনিধি সভা প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর চিত্ত রঞ্জন দাসের সভাপতিত্বে প্রতিনিধি সভায় বক্তব্য দেন অধ্যাপক ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক, যোসেফ সুধীন মণ্ডল, মনীন্দ্র কুমার নাথ। সভায় শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন ঢাকা মহানগর উত্তরের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অতুল চন্দ্র মণ্ডল।

এ ছাড়া জেলা নেতৃবৃন্দের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মুন্সীগঞ্জ জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট অজয় চক্রবর্ত্তী, নারায়ণগঞ্জ জেলা সভাপতি প্রদীপ কুমার দাস, নরসিংদী জেলা সভাপতি অধ্যক্ষ অহিভূষণ চক্রবর্ত্তী, মাদারীপুর জেলা সভাপতি শ্যামল দে, ঢাকা জেলা সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ কুমার দাস, নারায়ণগঞ্জ মহানগর সাধারণ সম্পাদক নিমাই দে, গাজীপুর জেলা সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নির্মল চন্দ্র মল্লিক, টাঙ্গাইল জেলা সাধারণ সম্পাদক সমরেশ পাল, গোপালগঞ্জ জেলা সাধারণ সম্পাদক দুলাল বিশ্বাস, শরীয়তপুর জেলা সাধারণ সম্পাদক সুদীপ্ত ঘোষ রানা, কিশোরগঞ্জ জেলা আহ্বায়ক অধ্যাপক প্রণব কুমার সরকার, মানিকগঞ্জ জেলা নেতা অ্যাডভোকেট দীপক ঘোষ। সভা সঞ্চালনা করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মতি লাল রায় ও ঢাকা মহানগর উত্তরের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হৃদয় চন্দ্র গুপ্ত।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আর্থিক খাত নিয়ে খারাপ খবর দিলেন গভর্নর

পৌরসভার ফাইল নিয়ে দুই কর্মকর্তার হাতাহাতি

কর্মস্থলে ‘অনুপস্থিত’, এবার পুলিশের ২ এসপি বরখাস্ত

এশিয়া কাপ দল নিয়ে তোপের মুখে বিসিসিআই

নারী-শিশুসহ ছয় ভারতীয় নাগরিক আটক

ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের জন্য সব প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার : উপদেষ্টা আসিফ

পিয়াইন নদীতে অবাধে বালু লুট, হুমকিতে বসতবাড়ি 

সোনালী ও জনতা ব্যাংকের অফিসার পদের ফল প্রকাশ

নরসিংদীতে একজনকে কুপিয়ে হত্যা

হোয়াটসঅ্যাপে নতুন কৌশলে অর্থ চুরি, যেভাবে নিরাপদ থাকবেন

১০

টিটিইসহ ৫ জন আসামি / তিন মাসেও শেষ হয়নি ট্রেন থেকে ফেলে হত্যার তদন্ত

১১

স্বামীর মোটরসাইকেল থেকে পড়ে স্ত্রীর মৃত্যু

১২

রওনা দিয়েছে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ, পাল্টা প্রস্তুতি ভেনেজুয়েলার

১৩

দেশে হবে আরও ৫১৬ কমিউনিটি ক্লিনিক

১৪

ফেসবুকে আমেরিকার বিরুদ্ধে কিছু বললেই পাবেন না ভিসা

১৫

মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে হতাহত পরিবারের পাশে তারেক রহমান

১৬

আশুলিয়ায় বিপুল অবৈধ সিগারেটসহ আটক ২

১৭

স্কুলছাত্র রনি হত্যা, যুবকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

১৮

সরকারি অনুদানে নির্মাণাধীন চলচ্চিত্রের মানোন্নয়নে সহযোগিতা করা হবে : মাহফুজ

১৯

শজিমেক হাসপাতালের উপ-পরিচালকের পদায়ন স্থগিতের দাবি

২০
X