রাজধানীর গুলশানে কূটনৈতিক পাড়ায় ‘হোলি আর্টিজান বেকারি’ নামের রেস্তোরাঁয় নৃশংস জঙ্গি হামলার সাত বছর পূর্ণ হলো আজ শনিবার (১ জুলাই)। দুনিয়া কাঁপানো ওই হামলায় দেশি-বিদেশি ২০ নাগরিককে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে জঙ্গিরা। প্রতিরোধ করতে গিয়ে জঙ্গি হামলায় নিহত হন পুলিশের দুই কর্মকর্তা, আহত হন আরও অনেকে।
পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুজাহেদীন অব বাংলাদেশ (জেএমবি) থেকে বেরিয়ে অতি উগ্রবাদী তরুণ জঙ্গিদের নিয়ে গঠিত ‘নব্য জেএমবি’ ওই হামলা চালায়।
হামলাকারী জঙ্গিরা ২০১৬ সালের ১ জুলাই রেস্তোরাঁটির ভেতরে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রেখেছিল অনেককে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের উদ্ধার করে। ঘটনার দিন সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে নিহত হয় সরাসরি হামলায় অংশ নেওয়া পাঁচ জঙ্গিসহ ছয়জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভয়াবহ ওই হামলার পর ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সফলতা এসেছে জঙ্গি ও উগ্রবাদীদের নিয়ন্ত্রণে। তবে আদর্শিকভাবে চলা জঙ্গি বা উগ্রবাদীদের পুরোপুরি নিঃশেষ করা সম্ভব নয়। তাই নজরদারি রাখতে হবে সব সময়। পাশাপাশি অব্যাহত রাখতে হবে জঙ্গিবিরোধী সচেতনতামূলক কার্যক্রমগুলো।
জঙ্গি দমনে যুক্ত পুলিশের এন্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ) ও ঢাকা মহানগর পুলিশের জঙ্গি দমন ইউনিট কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) কর্মকর্তারা বলছেন, টানা অভিযানের মুখে নব্য জেএমবি এখন একেবারেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। আপাতত নাশকতা চালানোর মতো সক্ষমতা এদের নেই। তবে অনলাইনে এরা কিছুটা সক্রিয় রয়েছে।
সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘নব্য জেএমবি নিয়ন্ত্রণে আছে। এই সংগঠনের অস্তিত্ব আছে বলে আমরা মনে করি না। অনলাইন পেট্রোলিংয়েও এদের অস্তিত্ব খুব একটা নেই।’
তিনি আরও বলেন, নব্য জেএমবিসহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনগুলো সার্বিকভাবে বলা যায় নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে এটাই শেষ কথা না। নিয়ন্ত্রণ বললেও তারা সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে।
জঙ্গি কার্যক্রম নজরদারি ও বিশ্লেষণে যুক্ত মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন কালবেলাকে বলেন, দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জঙ্গি কার্যক্রমের লাগাম টেনে ধরতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পেরেছে। গত সাত বছরে নব্য জেএমবির এমন তৎপরতা চোখে পড়েনি যে নতুন করে সংগঠিত হওয়া বা হামলার চালানোর সক্ষমতা এদের রয়েছে। এখন আর আশঙ্কাজনক অবস্থায় এরা নেই।
তিনি বলেন, বৈশ্বিক উগ্রবাদের যে ঢেউ ছিল বা এই জঙ্গিরা আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর যে সমর্থন পেত—তা বন্ধ হয়ে গেছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক, জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ কালবেলাকে বলেন, নব্য জেএমবির কার্যক্রম সীমিত হয়ে আছে, এটা সাদা চোখে বলা গেলেও এরা একটা আদর্শ নিয়ে কার্যক্রম চালায়। এজন্য এদের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর হলে এরা চুপ থাকে। তখন সদস্য সংগ্রহে নীরবে নানা কার্যক্রম চালায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে ঢিলেমি হলেই এদের আসল রূপ দেখা যায়। এজন্যই আমাদের সব সময়ে নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে।
সাত বছর আগে হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর বেরিয়ে আসে উচ্চশিক্ষিত তরুণরাও জড়িয়ে পড়েছে এই অন্ধকার পথে। তখন অপারেশনাল কার্যক্রমের পাশাপাশি তরুণদের সচেতন করতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এলাকা এবং মসজিদের খুতবাতে সচেতনতা কার্যক্রম চালানোর উদ্যোগ নেয়া হয়।
তবে এসব কার্যক্রমের কোনো কোনোটি এখন বন্ধ এবং কিছুটা চলছে ঢিলেঢালাভাবে। শুধু সিটিটিসি এবং র্যাব অপারেশনাল কার্যক্রমের পাশাপাশি জঙ্গিবিরোধী সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কারাবন্দি জঙ্গিদের ডি-র্যাডিক্যালাইজড করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা শুরু করা যায়নি এখনো।
জঙ্গিবাদ বিশেষজ্ঞ নূর খান লিটন বলেন, দেশে অপারেশনাল কার্যক্রম চালিয়ে উগ্রবাদীদের থামানো গেলেও দীর্ঘমেয়াদে সামাজিকভাবে এদের নিবৃত্ত করার কার্যক্রমটা ঢিলেঢালা। ডি-র্যাডিক্যালাইজড কার্যক্রম চালানো না হলে নতুন করে উগ্রবাদে প্রবেশের সুযোগ থেকে যায়।
অবশ্য সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলছেন, তারা বাইরে নানাভাবে ডি-র্যাডিক্যালাইজেশন (উগ্রবাদবিরোধী উদ্বুদ্ধকরণ) কার্যক্রম চালাচ্ছেন। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে হয়তো কারাগারে বন্দি জঙ্গিদের জন্য এই কার্যক্রম চালু করা যাবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, হোলি আর্টিজান বেকারিতে নৃশংস হামলার পর প্রথমে তারা হতভম্ব হয়ে গেলেও ঘুরে দাঁড়াতে বেশি সময় লাগানি। দ্রুত সময়ের মধ্যেই যেমন ওই হামলার কুশীলব, পরিকল্পনাকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নেয়া গেছে, তেমনি নানা ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানে নিহত হয়েছে নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা তামিম চৌধুরী ও সরোয়ার জাহানের মতো জঙ্গিরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় সিটিটিসির অভিযানে ৬৩ জন জঙ্গি নিহত হয়। গ্রেপ্তার হয়েছে সহস্রাধিক জঙ্গি। ভয়ংকর ওই হামলার পর র্যাবের অভিযানে দেড় হাজারের বেশি জঙ্গি ও উগ্রবাদী গ্রেপ্তার হয়। ১ হাজার ৬৭৮ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। অভিযান চালানো হয় অন্তত ৫৪টি জঙ্গি আস্তানায়।
সিটিটিসি কর্মকর্তারা বলছেন, ওই নৃশংসতার পর হোলি আর্টিজানে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ড’ নামে সেনা অভিযানে সরাসরি হামলায় যুক্ত পাঁচ জঙ্গি নিহত হলেও পুলিশি তদন্তে হামলায় নানাভাবে যুক্ত আরও ২১ জঙ্গির সম্পৃক্ততা মেলে। এরমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টানা অভিযানে বিভিন্ন আস্তানায় ১৩ জঙ্গি নিহত হয়।
ওই ঘটনায় দায়ের মামলায় পুলিশ আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। বিচার কার্যক্রম শেষে ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর নিম্ন আদালত নব্য জেএমবির জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, আব্দুস সবুর খান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপনকে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন ধারায় বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড দেন। অপর আসামি মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে খালাস দেন আদালত। তবে উচ্চ আদালতে ওই আসামিদের এখন চূড়ান্ত বিচার কার্যক্রম চলছে।
মন্তব্য করুন