গত দুই দশক ধরে ঢাকার নগর গঠন, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অর্থনীতিসহ পরিকল্পনার নানা বিষয়ে নিয়মিত লিখছেন স্থপতি অধ্যাপক ড. আদনান জিল্লুর মোর্শেদ। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এমন উল্লেখযোগ্য অর্ধশতাধিক লেখার সংকলন নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশ হয়েছে ‘ঢাকা ডেলিরিয়াম’।
শনিবার (১৫ জুলাই) সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের এলজিইডি ভবন মিলনায়তনে বইটির মোড়ক উন্মোচন হয়। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং বাংলাদেশ আরবান নলেজ হাব যৌথ উদ্যোগে ‘পারস্পেক্টিভ অন সাউথ এশিয়ান আরবানিজম’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠান আয়োজন করে।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের সভাপতিত্বে এতে মুখ্য আলোচক হিসেবে বক্তব্য দেন স্থপতি অধ্যাপক ড. আদনান জিল্লুর মোর্শেদ।
আলোচক হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির আরবান এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এ টি এম নুরুল আমিন, বেঙ্গল ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক স্থপতি কাজী খালেদ আশরাফ, অ্যাকশন-এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ। এ ছাড়া স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এমপি বলেন, আমরা এখন ঢাকার প্রলাপ শুনছি। নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে শহরটা অসুস্থ, কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসেছে। তবে যদি এটিকে সঠিক উপায়ে চিকিৎসা করা হয়, তবে আশা করি তা সেরে যাবে। আসলে সারা দেশের বিভিন্ন এলাকার অনেক মানুষ ঢাকায় আসার স্বপ্ন দেখে, এটাকে কপালের টিপ মনে করে। এতে করে এই শহরের মানুষ বাড়ে। মানুষের সংখ্যা বাড়লে তা সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা না গেলে সমস্যা আরও বাড়ে। তবে আশার কথা হলো, আমাদের শহর ও গ্রামের বৈষম্য এখন কমে এসেছে। এখন পুরো দেশকেই একটা ইউনিট হিসেবে বিবেচনা করে সামগ্রিকভাবে পরিকল্পনা করতে হবে। ঢাকার বাইরে অন্যান্য অঞ্চলেও যেন সুষমভাবে বিনিয়োগ হয় ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়, আমরা সেটি মাথায় রেখে কাজ করব।
‘ঢাকা ডেলিরিয়াম’-এর প্রশংসা করে পরিকল্পনা করে মন্ত্রী বলেন, আদনান মোর্শেদের মতো স্থপতি-গবেষকরা যেভাবে আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছেন, সেটিকে সাধুবাদ জানাই। এধরনের বিশ্লেষণী লেখা থেকে আমরা অনেক কিছু শিখি।
‘ঢাকা ডেলিরিয়াম’ বইটি সম্পর্কে ড. আদনান জিল্লুর মোর্শেদ বলেন, ‘একটা নগরকে বুঝতে হলে তার নিজস্ব চরিত্রকে বুঝতে হবে। পশ্চিমা বিশ্বের দৃষ্টিতে আমাদের ঢাকা বাসযোগ্যতার দিক থেকে তলানিতে। তাদের সংজ্ঞা এবং দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমাদের নগরকে বিচার করে আমরা হাহাকার করি। কিন্তু নগরের সাফল্য ও ব্যর্থতা বিচার করতে গেলে বহুমুখী মাপকাঠি প্রয়োজন। ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরে রূপান্তর করতে চাইলে এই শহরের বেড়ে ওঠার ধরন ও প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য, অর্থনীতি, মানুষের মিথস্ক্রিয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। আমাদের মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি লেন্স প্রয়োজন। গত কয়েক দশকে এককেন্দ্রিক উন্নয়নের ফলে আমরা সবকিছু রাজধানীকেন্দ্রিক করে ফেলেছি, যা ঢাকার ওপর চাপ বাড়িয়েছে। অথচ ঢাকা হতে পারতো অন্যতম সুন্দর শহর। এখনও সেই সম্ভাবনা পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। এজন্য সবার আগে নিজেদের অভ্যন্তরীণ দৃষ্টিভঙ্গির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে, উদ্ভাবনী পরিকল্পনায় জোর দিতে হবে’।
এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির আরবান এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এ টি এম নুরুল আমিন বলেন, ঢাকাকে রক্ষা করার জন্য নিউ টাউনশিপ দরকার। ঢাকা ডেলিরিয়ামে ঢাকার যে প্রলাপ শুনতে পাচ্ছি, তা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। এতে বিভিন্ন আঙ্গিকে ঢাকা শহরের সমস্যা-সম্ভাবনাকে উপস্থাপন করা হয়েছে।
বেঙ্গল ইনস্টিউটের মহাপরিচালক কাজী খালেদ আশরাফ বলেন, বই প্রকাশ খুবই আনন্দের ব্যাপার, আর যদি তা ঢাকা নিয়ে হয় তবে তা আরও বেশি আনন্দের। এই নগর সম্পর্কে অতীতে অনেকে লিখেছেন, তবে আদনান মোর্শেদের বইটি ভিন্ন, কারণে এর প্রতিটি লেখা বাস্তবিক অভিজ্ঞতার আলোকে এবং তা মানুষকে স্পর্শ করবে।
অ্যাকশন-এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, চরিত্র বিশ্লেষণ করলে মনে হচ্ছে ঢাকা এখন বহু চরিত্রের সংমিশ্রণ। এই শহরটা অনেক বড় হয়ে গেছে। সময় ও চাহিদার অনুপাতে এখানে নানাকিছু তৈরি হয়েছে, তবে এখনো নারীদের জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হয়নি। পাবলিক টয়লেটের সংখ্যাই এত অপ্রতুল যে, কর্মজীবী নারীরা প্রতিদিনকার জীবনে চরমভাবে ভুক্তভোগী হন। এই বিষয় নিয়ে আমাদের আরও সংবেদনশীল হয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের নগরচিন্তায় নারী-পুরুষকে সমানভাবে প্রাধান্য দিতে হবে।
নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, নগর নিয়ে একসময় খুব একটা লেখালেখি হতো না। এখন অনেকে লিখছেন। আদনান মোর্শেদ যেভাবে ঢাকা শহরকে ব্যাখ্যা করেছেন ও তা প্রাঞ্জল ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন, সেটি ভবিষ্যতের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য দলিল হয়ে থাকবে।
স্পেনভিত্তিক প্রকাশনা সংস্থা অলট্রিম পাবলিশার্স ‘ঢাকা ডেলিরিয়াম’ প্রকাশ করেছে। এর পাঠ প্রতিক্রিয়ায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান প্ল্যানিং অ্যান্ড ডিজাইন বিভাগের প্রধান রাহুল মেহরোত্রা লিখেছেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার নগরের প্রকৃত আবহ নিপুণভাবে ফুটে উঠেছে এই বইয়ে। নগরের সংস্কৃতি, মানুষের জীবনযাত্রা ও স্থাপত্যকে গভীরভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বইটি নগর-সমাজের প্রতি নাগরিক হিসেবে যে কারোর দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা মনে করিয়ে দেবে’।
বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের আগে ‘জনঘনত্বই হতে পারে ঢাকার আশীর্বাদ’ শিরোনামের একটি গবেষণাধর্মী প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এটি তৈরি করেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইনক্লুসিভ আর্কিটেকচার অ্যান্ড আরবানিজম (সিআইএইউ)। এতে ‘স্মার্ট ডেনসিটি’ গড়ে তোলা বা জনঘনত্বকে উপযুক্ত উপায়ে কাজে লাগিয়ে ঢাকা শহরের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, গণপরিবহন আধুনিকায়ন, পথচারীবান্ধব সড়ক, গণপরিসর নির্মাণসহ ঢাকাকে টেকসই ও বাসযোগ্য নগরীতে রূপান্তর নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। ড. আদনান জিল্লুর মোর্শেদ প্রামাণ্যচিত্রটি পরিচালনা, নির্দেশনা, গবেষণা ও ধারাবর্ণনা করেছেন।
ড. আদনান জিল্লুর মোর্শেদ ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের মাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন ও ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে ওয়াশিংটন ডিসির দ্য ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব আমেরিকার স্কুল অব আর্কিটেকচার অ্যান্ড প্ল্যানিংয়ের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
এ ছাড়াও তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইনক্লুসিভ আর্কিটেকচার অ্যান্ড আরবানিজমের নির্বাহী পরিচালক। ২০১৭-১৮ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের চেয়ারপারসন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। স্থপতি পরিচয়ের বাইরে তিনি একাধারে স্থাপত্য-ইতিহাসবিদ, নগরবিদ, গবেষক, কলামিস্ট এবং নগরবিষয়ক বক্তা হিসেবে সমাদৃত।
মন্তব্য করুন