এম এম মাহবুব হাসান
প্রকাশ : ০৬ জুন ২০২৫, ০৯:২৪ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

প্লাস্টিক দূষণ ঠেকাতে আর্থিক খাতের দায় 

এম এম মাহবুব হাসান। ছবি : সংগৃহীত
এম এম মাহবুব হাসান। ছবি : সংগৃহীত

পঞ্চাশের দশকে আবিষ্কৃত প্লাস্টিক একসময় আধুনিকতার প্রতীক ছিল। সাশ্রয়ী, বহুমুখী ও টেকসই এই উপাদান বিশ্বজুড়ে শিল্প, কৃষি, চিকিৎসা থেকে শুরু করে ঘরোয়া ব্যবহারে এক অনিবার্য জায়গা করে নেয়। কিন্তু কৃত্রিম এই বস্তু যখন বিপুল হারে উৎপাদিত হয়ে ব্যবহারের পর ব্যবস্থাহীনভাবে পরিবেশে মিশতে থাকে, তখন সেটি এক বৈশ্বিক সংকটে রূপ নেয়।

প্লাস্টিক এখন শুধু শহরের ড্রেন বা সাগরের পাড়েই নয়, মানুষের খাদ্যচক্রে, এমনকি রক্ত ও হৃৎপিণ্ডে জায়গা করে নিচ্ছে। ২০২৫ সালের বিশ্ব পরিবেশ দিবসে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) তাই ‘প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করুন’ শীর্ষক প্রতিপাদ্য নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে আহ্বান জানিয়েছে, তা নিছক প্রতীকী কোনো আয়োজন নয়, বরং এটি সময়ের এক কঠিন বাস্তবতা।

বিগত সাত দশকে বিশ্বে প্লাস্টিক উৎপাদন বেড়েছে কয়েক শত গুণ। প্রতিবছর প্রায় ৪৫ কোটি টন প্লাস্টিক উৎপন্ন হচ্ছে, যার ৪০ শতাংশই একবার ব্যবহারযোগ্য। সেগুলোর বিরাট অংশই শেষ পর্যন্ত জমা হয় প্রকৃতিতে—নদী, সাগর, বন কিংবা উন্মুক্ত জমিতে—যেখানে তা শত শত বছর অবিকৃত অবস্থায় থেকে যায়। এসব প্লাস্টিক ক্ষয়ে ক্ষয়ে পরিণত হয় মাইক্রোপ্লাস্টিকে এবং তা সহজেই জলজ প্রাণীর দেহে প্রবেশ করে এবং খাদ্যচক্র পেরিয়ে মানুষের শরীরেও ঢুকে পড়ে।

গবেষণা বলছে, একজন মার্কিন নাগরিক বছরে প্রায় এক লাখ মাইক্রোপ্লাস্টিক-কণা গ্রহণ করেন খাবার ও শ্বাসের মাধ্যমে। এসব কণায় থাকা রাসায়নিক পদার্থ, যেমন বিসফেনল বা থ্যালেটস শরীরে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে, বন্ধ্যত্ব, স্নায়বিক ব্যাধি এমনকি ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। এসব কণা মানুষের রক্ত, মস্তিষ্ক, প্ল্যাসেন্টা এমনকি হৃদ্‌যন্ত্রেও শনাক্ত হয়েছে। এটি একটি ভয়ংকর স্বাস্থ্যঝুঁকির সংকেত।

তবে মানবদেহের ঝুঁকি ছাড়াও প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব পড়ছে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যে। ইউনেসকোর হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর অন্তত ১০ লাখ সামুদ্রিক পাখি এবং ১ লাখ সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী প্লাস্টিক খেয়ে বা প্লাস্টিকে জড়িয়ে মারা যাচ্ছে। বৃহৎ সমুদ্রের ওপর দিয়ে একেকটি ‘প্লাস্টিক দ্বীপ’ ভেসে বেড়াচ্ছে, যেমন প্রশান্ত মহাসাগরে ৮০ হাজার টনের এক বিশাল আবর্জনার স্তূপ, যাতে রয়েছে প্রায় ১ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন প্লাস্টিকের টুকরা।

প্লাস্টিক দূষণের একটি বড় পরোক্ষ ক্ষতি হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। প্লাস্টিক মূলত জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে তৈরি হয় এবং এর উৎপাদন, পরিবহন ও ধ্বংসের প্রতিটি স্তরেই গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়।

গবেষণা বলছে, বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে প্লাস্টিক উৎপাদন থেকে বছরে ২ দশমিক ৮ গিগাটন কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হবে, যা বৈশ্বিক কার্বন সীমা (৪২০-৫৭০ গিগাটন) বজায় রাখার লক্ষ্যে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

এ সংকট থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। দেশে প্রতিবছর প্রায় ৯ লাখ ৭৭ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, যার প্রায় ৭০ শতাংশ অনুপযুক্তভাবে ফেলে দেওয়া হচ্ছে—খোলা ডাম্পিং, আগুনে পোড়ানো বা এদিক-সেদিক ফেলে রাখার মাধ্যমে।

এই ভুল ব্যবস্থাপনার ফলে পরিবেশগত অবক্ষয় ঘটছে, যেমন জলপথ বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং বন্যার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার প্রকোপ বাড়ছে। এমনকি ঢাকা শহরে, মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার বার্ষিক ২২.২৫ কেজিতে পৌঁছেছে, যা জাতীয় শহরাঞ্চলের গড়ের দ্বিগুণেরও বেশি।

তবে জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তবে এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে এখনো অনেক পথ বাকি।

এ প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠতে পারে—প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কী ভূমিকা থাকতে পারে? শুধু পরিবেশবিদ, সরকারি সংস্থা কিংবা ভোক্তাদের দায়িত্বে বিষয়টি ছেড়ে দিলে চলবে না। কারণ, অর্থনীতি, বিনিয়োগ ও ভোক্তা আচরণ নির্ধারণে আর্থিক খাতের প্রভাব অপরিসীম।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তারা অর্থায়নের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব উদ্যোগে গতি এনে দিতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো টেকসই অর্থায়নে প্রায় ১ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে, যা পূর্ববর্তী প্রান্তিক থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি। এই প্রবণতাকে যদি পরিবেশবান্ধব, প্রযুক্তিনির্ভর ও প্লাস্টিক-বিকল্প উদ্যোগের দিকে বিশেষভাবে মোড় নেওয়া যায়, তবে তা সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

ভারতের উদাহরণ উল্লেখযোগ্য—সেখানে ক্ষুদ্র শিল্প উন্নয়ন ব্যাংক (এসআইডিবিআই) ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য বায়োডিগ্রেডেবল পণ্য তৈরিতে সহজশর্তে অর্থায়ন করছে। বাংলাদেশেও এসএমই ফাউন্ডেশন ও বিভিন্ন ব্যাংকের এসএমই ইউনিটের মাধ্যমে এমন প্রণোদনা চালু করা যেতে পারে।

তবে বিনিয়োগের বাইরেও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের কর্মপরিবেশে প্লাস্টিকবিরোধী সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারে। অফিসে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করে তার পরিবর্তে কাচ, ধাতব বা কাগজের পণ্য ব্যবহার একটি কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে। অনেক আন্তর্জাতিক ব্যাংক ও করপোরেট সংস্থা ইতিমধ্যে এই পথ অনুসরণ করেছে।

বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পরিবেশ, সমাজ ও প্রশাসনের মানদণ্ড, অর্থাৎ ইএসজি স্কোর বিবেচনায় আনা গেলে তা আরও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। জাতিসংঘের দায়িত্বশীল বিনিয়োগ নীতিমালা (পিআরআই) অনুসরণ করে বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ৭০ শতাংশ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইএসজি স্কোর অনুসরণ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও ইতিমধ্যে টেকসই ব্যাংকিং সূচক চালু করেছে, যা একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ।

সবশেষে বলা যায়, করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার আওতায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্লাস্টিকবিরোধী ক্যাম্পেইন, সচেতনতা সেমিনার, বৃক্ষরোপণ বা পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্যের প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এসব কার্যক্রম কেবল করপোরেট ভাবমূর্তি রক্ষার মাধ্যম নয়, বরং সমাজ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সঙ্গে একটি দায়শীল সংযোগ গড়ে তোলার পথ।

একটি পরিচ্ছন্ন, সবুজ ও টেকসই ভবিষ্যৎ গঠনে আর্থিক খাতের ভূমিকা শুধু অর্থায়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, তারা নীতিনির্ধারক, পরামর্শদাতা ও সচেতনতা সৃষ্টিকারীর ভূমিকাও পালন করতে পারে। যখন আর্থিক ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের নীতিতে পরিবেশ-সচেতনতা যুক্ত করে, তখন ‘প্লাস্টিক বন্ধ হোক—প্রকৃতি বাঁচুক’, এই স্লোগান বাস্তব হয়ে ওঠে। আর সেটিই হতে পারে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিশ্রুতির বাস্তব প্রতিফলন।

লেখক : এম এম মাহবুব হাসান, ব্যাংকার ও উন্নয়ন গবেষক

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আসছে নিষেধাজ্ঞা, উপকূলজুড়ে বিষাদের ছায়া

হাজি সেলিমের বাড়ি থেকে ৬টি বিলাসবহুল গাড়ি জব্দ

বাগরাম দখলে পাঁয়তারা ট্রাম্পের, বাগড়া দিচ্ছে রাশিয়া-চীন-ইরান-পাকিস্তান

হজের তিন প্যাকেজ ঘোষণা, কমছে খরচ

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে দুদকের অভিযান

দুই দাবিতে ইউজিসিতে জবি ছাত্রদলের স্মারকলিপি প্রদান

ঢাকার ৮৯টি পূজামণ্ডপ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় বাড়তি নিরাপত্তা দিবে পুলিশ : ডিএমপি

যুবলীগের কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক গ্রেপ্তার

১ অক্টোবর খুলছে না কেওক্রাডং পর্যটন কেন্দ্র

আফগানদের বিপক্ষে চমক রেখে বাংলাদেশ স্কোয়াড ঘোষণা

১০

এশিয়া কাপের ফাইনাল, মোবাইলে যেভাবে দেখবেন

১১

অভিবাসন কেন্দ্র রক্ষায় পূূর্ণ শক্তি প্রয়োগের তাগিদ ট্রাম্পের

১২

দুই মাস ধরে পদ নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি : তথ্য উপদেষ্টা

১৩

মাঝে মাঝেই ঝাপসা দেখছেন? চোখ ক্যানসারের লক্ষণ কি না জেনে নিন

১৪

হঠাৎ কবরস্থানে বিস্ফোরিত হলো ককটেল, আতঙ্ক

১৫

ষষ্ঠীপূজা সম্পন্ন / মন্দিরে মন্দিরে দেবী ত্রিনয়নী

১৬

হাসিনের সুর ও সংগীতে কনার ‘নীরবে’

১৭

লালমনিরহাট বিদ্যুৎস্পর্শে ২ ভাইয়ের মৃত্যু

১৮

দুর্গাপূজার ছুটি ৪ দিন, এ বছর আর ছুটি বাকি কয়দিন

১৯

২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ৪ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ৮৪৫

২০
X