

চট্টগ্রাম বন্দরকে বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড বলা হয় শুধু আবেগের কারণে নয়, বাস্তবতার কারণেই। সমুদ্রপথে দেশের মোট বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ এই বন্দরের ওপর নির্ভরশীল। আমদানি-রপ্তানির সিংহভাগ কার্যক্রম, শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ, রপ্তানিযোগ্য পণ্যের বিশ্ববাজারে পৌঁছানো— সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। জাতীয় অর্থনীতির স্থিতিশীলতা, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে এই বন্দরের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই বন্দরের সক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক গতি ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা।
দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম বন্দর অবকাঠামোগত ঘাটতি, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতার বোঝা বয়ে এসেছে। বিশেষ করে ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়কালে বন্দরের সক্ষমতা ছিল চাহিদার তুলনায় অনেক কম। বার্থ, ক্রেন, গ্যান্ট্রি ও গুদামের স্বল্পতা, ম্যানুয়াল কনটেইনার হ্যান্ডলিং এবং ধীরগতির কাস্টমস প্রক্রিয়া বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করত। জাহাজকে বার্থ পেতে তিন থেকে সাত দিন, কখনো পিক সিজনে ১০ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। এর ফলে শিপিং লাইন ও ব্যবসায়ীদের বছরে শত শত কোটি টাকার ক্ষতি হতো। ডেমারেজ ও ডিটেনশন ফি, পণ্যের বিলম্বিত সরবরাহ এবং অনিয়ম-চুরির কারণে বন্দর হয়ে উঠেছিল ব্যবসায়ীদের জন্য এক ধরনের অনিশ্চয়তার প্রতীক।
২০১৫ সালের পর কিছু আধুনিকীকরণ উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তা ছিল আংশিক ও ধীরগতির। ক্রেন ও গ্যান্ট্রি বাড়ানো, সীমিত ডিজিটাল কাস্টমস চালু করা এবং ইয়ার্ড ব্যবস্থাপনায় কিছু সংস্কার বন্দরের গতি কিছুটা বাড়ালেও মৌসুমি চাপ, নদীর অগভীরতা এবং প্রশাসনিক জটিলতা পুরোপুরি কাটেনি। জাহাজের অপেক্ষার সময় এবং অতিরিক্ত খরচ কমলেও তা এখনো অর্থনীতির জন্য বড় বোঝা হয়ে ছিল। এই বাস্তবতায় চট্টগ্রাম বন্দরের আমূল রূপান্তর ছিল সময়ের দাবি।
২০২৫ সালের ডিসেম্বর মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যকর ও সমন্বিত উদ্যোগের ফলে চট্টগ্রাম বন্দর এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। এই রূপান্তরের মূল শক্তি ছিল ডিজিটালাইজেশন, দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। কাস্টমস ছাড়পত্র, বার্থ বরাদ্দ, ট্রাক চলাচল ও কনটেইনার ট্র্যাকিং একক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হওয়ায় অপারেশনে গতি ও স্বচ্ছতা এসেছে। আরএফআইডি, আইওটি ও সিসিটিভি নজরদারির মাধ্যমে মালামালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ায় চুরি ও অনিয়ম উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। যেখানে আগে ছাড়পত্র পেতে তিন থেকে পাঁচ দিন সময় লাগত, সেখানে এখন এক থেকে দুই দিনেই কাজ সম্পন্ন হচ্ছে।
একই সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদ সংস্কার ও দক্ষ মানবসম্পদ নিয়োগ বন্দরের ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছে। শিপ-টু-শোর ক্রেন, রাবার-টাইড গ্যান্ট্রি, ট্রাক ও লরি অপারেশন এখন সমন্বিতভাবে পরিচালিত হচ্ছে। জাহাজ আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই বার্থ বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে এবং মাত্র ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টায় লোডিং-আনলোডিং সম্পন্ন হচ্ছে। ড্রেজিং ও জেটি সম্প্রসারণের ফলে বড় জাহাজের আগমন সহজ হয়েছে এবং হ্যান্ডলিং ক্ষমতা দ্বিগুণ বেড়েছে। এর ফল হিসেবে জাহাজের ওয়েটিং টাইম কার্যত শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে এবং ডেমারেজ-ডিটেনশন খরচ বছরে কয়েকশ কোটি টাকায় সীমিত রাখা গেছে।
এই সাফল্যের প্রভাব সরাসরি জাতীয় অর্থনীতিতে পড়ছে। আমদানিকারকরা সময়মতো কাঁচামাল পেয়ে উৎপাদন চক্র সচল রাখতে পারছেন, রপ্তানিকারকরা আন্তর্জাতিক অর্ডার নির্ধারিত সময়ে পাঠাতে সক্ষম হচ্ছেন। উৎপাদন ব্যয় কমছে, বাজারে পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল থাকছে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন বাড়ছে। চট্টগ্রাম বন্দর এখন কেবল একটি বন্দর নয়, বরং বাংলাদেশের শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিক গতিশীলতার প্রধান চালিকাশক্তি।
তবে এই অগ্রগতি ধরে রাখতে হলে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। বিশ্বমানের বন্দরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে আরও আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন : অটোমেটেড গাইডেড ভেহিকেলস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রেডিক্টিভ মেইনটেনেন্স, ডিজিটাল টুইন সিস্টেম ও ব্লকচেইন লজিস্টিক ট্র্যাকিং বাস্তবায়ন জরুরি। পাশাপাশি নদীর গভীরতা বৃদ্ধি, পরিবেশবান্ধব ড্রেজিং এবং অবকাঠামো সম্প্রসারণ অব্যাহত রাখতে হবে। আঞ্চলিক ট্রানজিট সুবিধা সম্প্রসারণ করে নেপাল, ভুটান ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে যুক্ত করতে পারলে বাংলাদেশ একটি আঞ্চলিক বাণিজ্যিক হাবে পরিণত হতে পারে।
সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সাম্প্রতিক রূপান্তর প্রমাণ করে, সঠিক পরিকল্পনা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা থাকলে বাংলাদেশের মতো দেশও বিশ্বমানের অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারে। এই বন্দর আজ শুধু দেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যিক মানচিত্রে বাংলাদেশের শক্ত অবস্থানের প্রতীক।
মন্তব্য করুন