এ এইচ এম ফারুক
প্রকাশ : ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:৫৬ পিএম
আপডেট : ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ০৪:১৪ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

পাহাড়ে সন্ত্রাসী তৎপরতা বাড়ছে, সেনাবাহিনী কেন লক্ষ্যবস্তু?

পাহাড়ে সন্ত্রাসী তৎপরতা বাড়ছে, সেনাবাহিনী কেন লক্ষ্যবস্তু?

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের অহংকার। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে জাতিসংঘ মিশনে সুনামের সাথে সাহসিকতা ও পেশাদারত্বের সাথে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে তারা প্রশংসিত। এই বাহিনীর সদস্যরা রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আর মানবিক সেবার প্রতীক হিসেবে বিশ্বশান্তি রক্ষায় শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে, বিশেষ করে কৌশলগতভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে, এই গর্বিত বাহিনী এক ভিন্ন, দীর্ঘ এবং নীরব যুদ্ধের সম্মুখীন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের অখণ্ডতা রক্ষায় নিয়োজিত সেনা সদস্যরা বারবার দেশীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর, যেমন— পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ), মগ লিবারেশন পার্টি (এমএলপি) কর্তৃক হামলার শিকার হচ্ছেন। এই হামলায় দেশের গর্বিত বাহিনীর সদস্যরা নিহত ও আহত হয়েছেন। প্রশ্ন হলো— জাতিসংঘের মতো বৈশ্বিক রণক্ষেত্রে যারা দুর্ধর্ষ সাহসিকতা দেখান, দেশের ভেতরে দেশের ভূখণ্ড রক্ষায় কেন তাদের এত মূল্য দিতে হচ্ছে?

এই প্রবন্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর ওপর ধারাবাহিক হামলার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, ভূরাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের বলয় এবং ‘সেনাবাহিনী হটাও’ আন্দোলনের নেপথ্যের উদ্দেশ্যগুলো বিশ্লেষণ করব। একই সঙ্গে, রাষ্ট্রের জন্য এই জটিল নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয় কী, তার একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত দিকনির্দেশনা দেওয়ার চেষ্টা করব। কারণ এই সংঘাত নিছক আইনশৃঙ্খলার সমস্যা নয়; এটি একটি গভীর শিকড়যুক্ত নিরাপত্তা সংকট, যা বহিরাগত ভূরাজনৈতিক চাপ, অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র এবং ভুল রাষ্ট্রীয় কৌশলের ফল।

ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা; দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে বহুমুখী চাপ ও ষড়যন্ত্রের বলয়

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম, একটি জটিল ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে অবস্থান করছে। বঙ্গোপসাগর একদিকে যেমন বাণিজ্যিক গুরুত্ব বহন করে, তেমনি ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরাম, এবং দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমারের রাখাইন (আরাকান) রাজ্য সংলগ্ন এই অঞ্চলটি আন্তর্জাতিক কৌশল ও নিরাপত্তা ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

পার্বত্য চুক্তি-পরবর্তী সংঘাত সেনা টহলে হামলা; ১৯৯৭-২০২২

১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি (কথিত শান্তি চুক্তি) দীর্ঘ দুই দশকের সশস্ত্র সংঘাতের সমাপ্তি ঘটানোর কথা থাকলেও, চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করে ইউপিডিএফ -এর মতো নতুন সশস্ত্র সংগঠনের উত্থান হয়। এর ফলে পাহাড়ে সশস্ত্র সংঘাত বহুধা বিভক্ত হয়ে আরও জটিল আকার ধারণ করে।

গোষ্ঠীগত বিভাজন ও আন্তঃসংঘাতের আড়ালে সেনাবাহিনী টার্গেট

চুক্তি-পরবর্তী সময়ে জেএসএস (মূল), ইউপিডিএফ (মূল), এবং অন্যান্য উপদলের সৃষ্টি হয়। এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায় চাঁদাবাজি ও নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। তবে রাষ্ট্রের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য তারা নিয়মিত সেনা অভিযান ও টহলে হামলা অব্যাহত রাখে।

এই সময়ের কিছু নৃশংস চিত্র

রাজস্থলীতে সেনা সদস্য নাসির উদ্দিন হত্যা : ৬ অক্টোবর ২০১৮ রাঙামাটির রাজস্থলী উপজেলার বাঙ্গালহালিয়া এলাকার একটি নির্মাণাধীন সড়কের দায়িত্বে থাকা সৈনিক নাছির উদ্দিনকে স্থানীয় একটি নির্মাণ সাইট থেকে অপহরণ করা হয় এবং পরে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এই ঘটনার পেছনে পাহাড়ের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী জড়িত ছিল। তথ্যসূত্র-আইএসপিআর বিজ্ঞপ্তি ও জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন।

সাজেক ও বাঘাইছড়ির ঘটনা : ২০১৯ সালের ৬ মে বাঘাইছড়ির সাজেকে টহলরত সেনাদের লক্ষ্য করে গুলি এবং ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর বাঘাইছড়ির বঙ্গলতলী এলাকায় একজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। যা কেবল বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং রাষ্ট্রীয় বাহিনীর উপর সরাসরি চ্যালেঞ্জ। তথ্যসূত্র- আইএসপিআর বিজ্ঞপ্তি ও জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন।

বুড়িঘাটে সেনা টহলে হামলা : ২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর রাঙামাটির নানিয়ারচর সংলগ্ন বুড়িঘাট এলাকায় সেনা টহল লক্ষ্য করে ইউপিডিএফ অতর্কিত গুলি চালায়। হামলায় সৈনিক শাহাবুদ্দিন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। সেনাবাহিনীর পাল্টা গুলিতে ইউপিডিএফের দুইজন সশস্ত্র সদস্য নিহত হয়। তথ্যসূত্র- আইএসপিআর বিজ্ঞপ্তি ও জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন।

রাঙামাটিতে পাহাড়ি নারীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার

সবচেয়ে নিন্দনীয় কৌশলগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো রাঙামাটিতে পরিকল্পিতভাবে পাহাড়ি নারীদের সামনে এগিয়ে দিয়ে সেনা টহলে হামলা চালানো। ২০১৯ এবং ২০২০ সালে রাঙামাটির বিভিন্ন স্পর্শকাতর এলাকা, বিশেষ করে বাঘাইছড়ি, লংগদু ও নানিয়ারচর অঞ্চলে একাধিক ঘটনা ঘটেছে। এটি একদিকে যেমন সেনাবাহিনীকে দুর্বল পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়, তেমনি অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মহলে অপপ্রচারের সুযোগ তৈরি করে। এই সময়ে সহিংসতাগুলোর পেছনে জনতাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার, সেনাবাহিনী তথা রাষ্ট্রবিরোধী স্লোগান ও প্রচারণা এবং তথ্য সন্ত্রাস অব্যাহত ছিল।

খাগড়াছড়ির সাম্প্রতিক (২০২৩-২০২৫) ঘটনা

২০২৩-২০২৫ সময়কালে খাগড়াছড়ি জেলায় সশস্ত্র গোষ্ঠী ইউপিডিএফ এবং জেএসএস-এর সংঘাত ও সেনাবাহিনীর ওপর চাপ বজায় ছিল। খাগড়াছড়ি জেলায় একটি ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগকে কেন্দ্র করে এ বছরে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে হওয়া আন্দোলন ও বিক্ষোভের সুযোগ নিয়ে সামরিক যান ও টহলের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। বিক্ষোভের সুযোগ নিয়ে সশস্ত্র দুষ্কৃতকারীরা সামরিক যানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। একপর্যায়ে টহল দলের ওপর গুলি ও পাথর নিক্ষেপের মতো আক্রমণ চালানো হয়। এই হামলায় একজন কর্মকর্তাসহ কমপক্ষে ১১ জন সেনা সদস্য গুরুতর আহত হন। তথ্যসূত্র: আইএসপিআর বিবৃতি এবং জাতীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন।

সাম্প্রতিক চ্যালেঞ্জ

২০২৩ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা পরিস্থিতি এক নতুন ও ভয়াবহ মোড় নেয়। কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে নতুন একটি সশস্ত্র সংগঠনের উত্থান হয়, যাদের সামরিক কৌশল এবং আক্রমণের ধরন আগের গোষ্ঠীগুলো থেকে আরও বেশি আক্রমণাত্মক।

কেএনএফ-এর উত্থান ও নতুন সামরিক কৌশল

কেএনএফ, যাদের কথিত সামরিক শাখা কেএনএ (কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি), তারা বান্দরবানের রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলাকে কেন্দ্র করে সক্রিয় হয়। এদের অন্যতম প্রধান কৌশল হলো আইইডি (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) বা পুঁতে রাখা বোমা ব্যবহার করে অতর্কিত হামলা চালানো।

বান্দরবানের দুর্গম এলাকায় সেনা কর্মকর্তা নিহত

২০২৩ সালের মার্চে বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে কেএনএফের গুলিতে মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন নিহত হন। একই বছর মে মাসে রুমা উপজেলায় কেএনএর সন্ত্রাসীদের আইইডি বিস্ফোরণ ও অতর্কিত গুলিতে সেনাবাহিনীর দুজন সৈনিক (মো. আলতাফ আহম্মদ এবং মো. তৌহিদ) নিহত হন। এইক বছরের জুনে বান্দরবানের রুমায় বিশুদ্ধ পানি ও খাওয়ার স্যালাইন বিতরণ করতে গিয়ে কেএনএফ সন্ত্রাসীদের পুঁতে রাখা আইইডি বিস্ফোরণে নিহত হন সৈনিক মোন্নাফ হোসেন। এরপর সেনাবাহিনী ও যৌথবাহিনীর বান্দরবানের দুর্গম এলাকায় অভিযান পরিচালনা কালে কেএনএ-এর একজন সামরিক কমান্ডারসহ দুইজন নিহত হয়েছেন।

পাহাড়ে সেনা টহলে ধারাবাহিক (১৯৭৭-১৯৯২) হামলা

পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর ওপর হামলা কোনো নতুন ঘটনা নয়। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি, ধারাবাহিক এবং পরিকল্পিত সহিংসতা, যার সূচনা হয় ১৯৭৭ সালে পিসিজেএসএস শান্তি বাহিনীর সশস্ত্র উত্থানের মাধ্যমে। সেই সময় থেকে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি (কথিত শান্তি চুক্তি) পর্যন্ত সামরিক বাহিনী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল। এই সময়কালে সেনাবাহিনীর রক্ত ঝরেছে থেমে থেমে, নিরবেই।

সংঘাতের সূত্রপাত ও রক্তক্ষয়; ১৯৭৭-এর নৃশংসতা

ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, সামরিক বাহিনীর ওপর প্রথম বড় ধরনের আঘাত আসে ১৯৭৭ সালে। ১৯৭৭ সালের ৬ মে সাঙ্গু নদীতে অ্যামবুশ করে শান্তি বাহিনী সৈনিক আব্দুল কাদিরসহ ৫ জন সেনা সদস্যকে হত্যা করে পিসিজেএসএস-এর সশস্ত্র শাখা কথিত শান্তিবাহিনী। ১৯৭৭ সালের ২৫ অক্টোবর বান্দরবানে আরও ৬ জন সেনা সদস্য নিহত হন। এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে, ১৯৭৭ সাল থেকেই বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীটি কোনো নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিল না, বরং তাদের মূল লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীকে টার্গেট করে একটি সশস্ত্র সংঘাতের সূচনা করা।

এক কালো অধ্যায় ও সামরিক ট্র্যাজেডি ‘১৯৮০’

১৯৮০ সাল ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়, যখন সামরিক বাহিনীর ওপর সবচেয়ে বড় ও মর্মান্তিক হামলাগুলো ঘটেছিল। ১৯৮০ সালে ২৩ জানুয়ারি খাগড়াছড়ি সদরে সেনা টহলে হামলায় ৩ জন সেনা সদস্য নিহত হন এবং ৫ জন আহত হন। একই বছরের ১ মার্চ কনিছড়া নামক স্থানে শান্তি বাহিনী অ্যামবুশ করে মেজর মহসীন আলমসহ ২২ জন সেনা সদস্যকে হত্যা করে। এটি ছিল এক পরিকল্পিত হামলা, যা সামরিক রসদ লুটপাট এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার লক্ষ্য নিয়ে চালানো হয়েছিল। ঐ বছরের ২১ এপ্রিল ফালাউংপাড়ায় অ্যামবুশ করে ১১ রাইফেল ব্যাটালিয়নের ২০ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়। এই ধারাবাহিক হত্যাকা-গুলো কেবল সেনা সদস্যদের প্রাণহানি ঘটায়নি, বরং স্থানীয়ভাবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও প্রশাসনের উপর চরম চাপ সৃষ্টি করেছিল।

১৯৭৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি শান্তি বাহিনী সাঙ্গু নদীতে আবারও অ্যামবুশ করে এক সেনা সদস্যকে হত্যা করে। ১৯৮৬ সালের ১৯ জুলাই সেনা টহলে হামলায় ১ জন সেনা সদস্য নিহত এবং ৭ জন আহত হন। ১৯৮৭ সালের ২১ জুন নাড়াইছড়ির অদূরে শান্তি বাহিনী অ্যামবুশ করে আব্দুর রাজ্জাক, ইসমাইল হোসেন এবং মোহন লালসহ ৩ জন সেনা সদস্যকে হত্যা করে। ১৯৮৯ সালের ২ নভেম্বর শিলছড়িতে সেনা টহলে হামলায় ২ জন সেনা সদস্য নিহত হন। একই বছরে থানচি থেকে ১১ জন সেনা সদস্যকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়। ১৯৯২ সালের ২৯ জুন মহালছড়ি উপজেলার রাঙামাটি সড়কে নিরাপত্তা বেঞ্চের উপর অতর্কিত হামলায় আরও ২ জন সেনা সদস্য নিহত হন।

এই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলারক্ষার জন্য নয়, বরং এটি দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, ভূখণ্ডের অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব। এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, সেনাবাহিনী এখন শুধু বন্দুকের গুলির শিকার হচ্ছে না, বরং আইইডির মতো গেরিলা যুদ্ধ কৌশলের সম্মুখীন হচ্ছে।

করণীয় : জাতীয় নিরাপত্তা ও কৌশলগত পুনর্বিন্যাস

পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা একটি বহুমুখী সমস্যা, যার জন্য সামরিক, কূটনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সুসমন্বিত পদক্ষেপের প্রয়োজন। বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর ধারাবাহিক হামলা এবং ভূরাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে, রাষ্ট্রকে অবশ্যই একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পুনর্বিন্যাস নীতি গ্রহণ করতে হবে।

১. সামরিক সক্ষমতা ও কৌশলগত উপস্থিতি পুনঃস্থাপন

পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে সবার আগে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। সংঘর্ষপ্রবণ এলাকায় সেনা ঘাঁটি পুনঃস্থাপন : যেখানে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছিল, সেখানে কৌশলগত কারণে অবিলম্বে তা পুনরায় স্থাপন করা আবশ্যক। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, সীমান্তে এবং অভ্যন্তরীণ সংঘাতপ্রবণ এলাকায় সামরিক উপস্থিতি কমানো মানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে ‘নিরাপত্তা শূন্যতা’ তুলে দেওয়া। তাই ‘ফরোয়ার্ড ডিফেন্স’ নীতি গ্রহণ করে দুর্গম এলাকায় সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

প্রযুক্তি ও সামরিক আধুনিকীকরণ : পাহাড়ি ভূখণ্ডের জন্য উপযোগী উন্নত সামরিক প্রযুক্তি (যেমন- ড্রোন নজরদারি, আইইডি প্রতিরোধক যান, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা) এবং সেনাবাহিনীর জন্য বিশেষ নিরাপত্তা বাজেট বরাদ্দ করা অপরিহার্য। কেএনএফ-এর মতো গোষ্ঠীর আইইডি ব্যবহারের কৌশল মোকাবিলায় প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।

সন্ত্রাস দমনে তথ্য-নির্ভর অভিযান : সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বিত গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক স্থাপন করতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৎপরতা এবং চোরাচালান রুটগুলোর গতিবিধি বিশ্লেষণ করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক অভিযান পরিচালনা করতে হবে।

২. আন্তর্জাতিক প্রচারণা ও কূটনৈতিক প্রতিরোধ

বাংলাদেশের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতার বিরুদ্ধে হওয়া আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র (যেমন- ‘গ্রেটার ত্রিপুরা ল্যান্ড’ দাবি) এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।

কূটনৈতিক আক্রমণ : আন্তর্জাতিক ফোরামে (জাতিসংঘ, ওআইসি) বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যেকোনো উসকানির (যেমন : ভূখণ্ড নিয়ে বিতর্ক) বিরুদ্ধে জোরালো কূটনৈতিক প্রতিবাদ জানাতে হবে।

সঠিক তথ্য প্রচার : আন্তর্জাতিক এনজিও ও তথাকথিত মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অপপ্রচারের জবাব দিতে সশস্ত্র বাহিনীর গণসংযোগ পরিদপ্তরের মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে সঠিক তথ্য ও সামরিক কার্যক্রমের যৌক্তিকতা বিশ্ব মহলে তুলে ধরতে হবে। তথ্য সন্ত্রাস মোকাবিলায় এটিই একমাত্র কার্যকর উপায়।

৩. স্থানীয় জনগণের সঙ্গে আস্থা ও সহাবস্থান

কেবল সামরিক উপায়ে শান্তি সম্ভব নয়। পাহাড়ে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হলে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে আস্থা ও সহাবস্থানের সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন।

আস্থার সেতু বন্ধন ও সামাজিক নিরাপত্তা : স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং আর্থ-সামাজিক কার্যক্রমে সেনাবাহিনীর ভূমিকা আরও বাড়ানো উচিত। বিশেষ করে দুর্গম অঞ্চলে চিকিৎসাসেবা ও জরুরি ত্রাণ বিতরণে সামরিক বাহিনীর উদ্যোগ উপজাতি ও বাঙালি উভয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সেনাবাহিনীর গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারে।

প্রশাসনিক সক্ষমতা বৃদ্ধি : প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে শক্তিশালী করে সামরিক বাহিনীর ওপর চাপ কমাতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে প্রশাসনকে আরও সক্রিয় ও দুর্নীতিমুক্ত করা আবশ্যক।

উপসংহার

পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থিরতা, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, সীমান্ত উত্তেজনা এবং সশস্ত্র হামলা সবকিছু মিলিয়ে এটি বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি স্থায়ী চ্যালেঞ্জ। এই ভূখণ্ড কেবল একটি ভৌগোলিক অঞ্চল নয়, এটি বাংলাদেশের কৌশলগত হৃদপিণ্ড। এই অঞ্চলে নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে দেশের সামগ্রিক সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে।

সেনা সদস্যদের রক্তপাত শুধু ইতিহাস নয় এটি রাষ্ট্রের দায়। এটি নিছক স্মরণ নয়, বরং একটি কার্যকর প্রতিরক্ষা নীতির দাবি। যে সকল সেনা সদস্য দেশকে রক্ষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন, তাদের আত্মত্যাগ কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে পারে না।

এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজন সামরিক, কূটনৈতিক ও সামাজিক সমন্বয়ের একটি বহু-মাত্রিক কৌশল। রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তর—নিরাপত্তা বাহিনী, প্রশাসন, গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজ—এই সংকট মোকাবিলায় একযোগে কাজ করলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ ও কৌশলগতভাবে শক্তিশালী অঞ্চলে পরিণত করা সম্ভব।

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আরও ৫৩ জুলাই যোদ্ধার গেজেট বাতিল

অবৈধ ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার নিয়ে ডিএনসিসির নির্দেশ

জাল কাগজপত্র জমা দিলে ১০ বছরের ভিসা নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি

মৃত্যুর আগে ১১ জনকে দায়ী করে বিএনপি নেতার ভিডিও বার্তা

মিরপুর টেস্টে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য বিসিবির বিশেষ সুবিধা

আইসিসি থেকে দুঃসংবাদ পেলেন বাবর

কারাবন্দি সাবেক মেয়র আইভী আরও ৫ মামলায় গ্রেপ্তার

মাদুরোর সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী ট্রাম্প, সেনা মোতায়েনেরও সম্ভাবনা

মর্টার শেলের আঘাতে কেঁপে উঠল পুরো এলাকা

ফের ঢাকায় আসছেন আতিফ আসলাম

১০

শিশু ধর্ষণের অভিযোগে ৭৫ বছরের বৃদ্ধ গ্রেপ্তার

১১

আকর্ষণীয় দাড়ি চাইলে প্রয়োজন বাড়তি যত্নের, রইল টিপস

১২

নির্বাচন কবে, জার্মানির রাষ্ট্রদূতকে জানালেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

১৩

দেশে মোট ভোটারের চূড়ান্ত সংখ্যা প্রকাশ

১৪

রাতে বিদেশযাত্রার অনুমতি চাইলেন স্বামী, সকালে না ফেরার দেশে

১৫

পুলিশের সামনে ছাত্রলীগের মিছিল, এসআই ক্লোজড

১৬

‘সুখবর’ পেলেন বিএনপির আরেক নেতা

১৭

পাহাড়ে সন্ত্রাসী তৎপরতা বাড়ছে, সেনাবাহিনী কেন লক্ষ্যবস্তু?

১৮

‘শেখ হাসিনার ফাঁসি কার্যকর হলে শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে’

১৯

‘ছেলের কথা শুনতে পারলে কলিজাটায় শান্তি লাগতো’

২০
X