আয়েশা জালাল
প্রকাশ : ২২ আগস্ট ২০২৩, ০৭:১৪ পিএম
আপডেট : ২২ আগস্ট ২০২৩, ০৭:৩০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
দ্য ডিপ্লোম্যাটের নিবন্ধ

কর্তৃত্ববাদের ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার

দক্ষিণ এশিয়ায় কর্তৃত্ববাদের ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার। ছবি : সৌজন্য
দক্ষিণ এশিয়ায় কর্তৃত্ববাদের ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার। ছবি : সৌজন্য

রাষ্ট্রের আদর্শ এবং প্রকৃত বাস্তবতার মধ্যে বিরাট দ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও, রাজনীতিতে গণতন্ত্রের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আজ আর নেই। তথাপি শাস্ত্রীয় গণতন্ত্র এবং বিশ্বব্যাপী আমাদের দেখা গণতন্ত্রের মধ্যে রয়ে গেছে বিস্তর এক ফারাক।

গ্লোবাল সাউথ থেকে অভিবাসীদের বাদ দিতে বা দেশের অভ্যন্তরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের টার্গেট করার জন্য জনপ্রিয় সব স্লোগান ব্যবহার করেছে ডানপন্থীরা। ডানপন্থীদের এই উত্থান ‘গণতন্ত্রের ঘাটতির’ বিরুদ্ধে বড় ধরনের একটি শোরগোল তৈরি করেছে।

কিন্তু, এ ধরনের কুসংস্কারমূলক ও অগণতান্ত্রিক চর্চা কোনো নতুন ঘটনা নয়। ঐতিহাসিক ভাবেই এর ভিত্তি রয়েছে। গণতান্ত্রিক আকাঙ্খা এবং কর্তৃত্ববাদী দমন-পীড়নের অগণিত ঘটনাগুলো বিশেষ করে ঔপনিবেশিকতার উত্তরাধিকার থেকে পাওয়া যায়।

ঔপনিবেশিক শাসনের মূল দায়িত্ব ছিল শোষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরাপত্তা দেওয়া। তারা শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আইনের ডালি সাঁজিয়ে রাখতো এবং জনগণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্তরের জবরদস্তিমূলক শক্তি প্রয়োগ করতো।

ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী সংগ্রামকে অনুপ্রাণিত করে এমন স্বাধীনতা এবং আর্থ-সামাজিক আকাঙ্খার প্রচার করেনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্ব ব্যবস্থা। পরিবর্তে তা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোর নিপীড়নমূলক এবং অসাম্যমূলক কাঠামো এবং নীতিগুলোকেই বজায় রেখেছে।

স্নায়ুযুদ্ধের সময়কালে, উন্নত পুঁজিবাদী বিশ্বের কাছে একের পর এক আত্মসমর্পণ করে এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার উন্নয়নশীল দেশগুলো। সে সময় ওয়াশিংটন এবং তার মিত্রদের হতে এসব উন্নয়নশীল দেশ ব্যাপক সামরিক কর্তৃত্ববাদের শিকার হয়। বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রচারের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রতিশ্রুতি তা কখনোই ওয়াশিংটনকে সামরিক স্বৈরশাসক এবং স্বৈরাচারি শাসকদের সমর্থন করতে বাঁধা দেয়নি। অথচ ওয়াশিংটনের নীতি ছিল এতে বাঁধা দেওয়া।

আজও সে পরিস্থিতি ভিন্ন কিছু নয়। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন মিত্র পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র কাঠামোকে শক্তিশালী করতে অনেক কিছুই করেছে ওয়াশিংটন। তবে ইসলামাবাদ চীনের দিকে ঝুঁকে গেলে তা ওয়াশিংটনের ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্যগুলোর সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে। ফলে তারা আবার পাকিস্তানকে তাদের গণতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতির পর্যায়ক্রমিক পুনঃবিবৃতির জন্য একটি সুবিধাজনক লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে।

অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সূচকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি থাকা সত্ত্বেও, নির্বাচনী জালিয়াতি ও গণতন্ত্রের অপূর্ণতাগুলো সংশোধনে বাংলাদেশকে চাপ প্রয়োগ করছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের বাণীগুলো সাবেক বৃটিশ রাজের উত্তরাধিকার থেকে এসেছে। ব্রিটিশ রাজকে প্রতিস্থাপনকারী দেশগুলোতে বৃটিশদের সেই গণতন্ত্রের সংজ্ঞা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রায় এসে পৌঁছেছে।

আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদের উৎকৃষ্ট উদাহরণ- ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের গণতন্ত্রের বক্তৃতা। যার প্রধান লক্ষ্য প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান তৈরি করে সেখানে সুবিধাপ্রাপ্ত একটি শ্রেণি তৈরি করা। যারা উন্নয়নের প্রচারের জন্য একটি উপযুক্ত অবকাঠামো তৈরি করার চেষ্টা করে।

আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদের উত্তরাধিকার থেকে উদ্ভূত নাগরিকত্বের যে কোনো ধারণাই ঔপনিবেশিক যুগের বিকৃতি ও দুর্ভাগ্য এড়াতে পারেনি।

পাকিস্তান সুদীর্ঘ কাল ধরে সামরিক-আমলাতান্ত্রিক শাসনের আদর্শ হয়ে উঠেছে। সেখানে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করার যুদ্ধই এর গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কেন্দ্রবিন্দু। ২০০৮ এবং ২০১৭ সালে ইসলামাবাদের শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্ররোচণা এবং জটিল অর্থনৈতিক সমস্যার মুখে পুরানো কর্তৃত্ববাদ কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল।

পাকিস্তানের একটি ইতিবাচক অগ্রগতি হলো- জবাবদিহিতা কমে যাওয়ার শঙ্কার সাথে সাথে সেখানে একটি বিচার বিভাগীয় সক্রিয়তার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। সেনাবাহিনী প্রধান, রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতা বণ্টণের অস্বস্তিকর সমীকরণে চতুর্থ উপাদান হিসাবে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির আবির্ভাব যে ইতিবাচক তাতে কারো দ্বিমত নেই। কিন্তু একজন প্রধানমন্ত্রী, একজন প্রধান বিচারপতি বা রাষ্ট্রপতির যতই জনপ্রিয়তা থাকুক না কেন সেনাবাহিনীর প্রধানই এখনও পাকিস্তানের শীর্ষ ক্ষমতার অধিকারী।

খাকি-পোষাকের কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেয়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে লড়াই করার প্রবণতা নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে। প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কারের অভাবে পাকিস্তান আজ অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত।

বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে রয়েছে তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এই দুটি দলই গত তিন দশক ধরে পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের সরকার ও বিরোধী দলের আসনে রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় এখনো গণতন্ত্র জীবিত থাকলেও তার দশা হয়েছে কলঙ্কিত এবং ভঙ্গুর। বাস্তবের সাথে গণতন্ত্রের আদর্শগুলো এখানে সংগ্রাম করছে।

ঔপনিবেশিক আমলের অনেক কর্তৃত্ববাদী বৈশিষ্ট্যই উত্তর-ঔপনিবেশিক দক্ষিণ এশিয়ায় স্থায়ী হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই কর্তৃত্ববাদ আরও শক্তিশালী রূপ ধারণ করেছে।

ঔপনিবেশিক যুগের আরেকটি উজ্জ্বল ধারাবাহিকতা হল- দমনমূলক আটকের নীতি। কোনো ব্যক্তি সরকার বা ক্ষমতা কাঠামোর বিরুদ্ধমত হলে বা ক্ষমতা কাঠামোর বিরুদ্ধে কথা বললে তাকে দমনমূলক আটক করা হয়। বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে এই নীতির অনুশীলন হচ্ছে। এসব দেশে বহু মানুষকে বিনা বিচারে বন্দি করা হয় এবং বন্দি রাখা হয়।

১৯১৯ সালে বৃটিশদের প্রণীত যুদ্ধকালীন অধ্যাদেশ (যে আইনে বিনা বিচারে ভারতীয়দের বন্দি করার সুযোগ দেওয়া হয়) এর বিরুদ্ধে প্রথম সর্বভারতীয় গণ আন্দোলন শুরু করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। গান্ধীর পরিভাষায় এগুলো ছিল- ‘অনিয়ম আইন’। বৃটিশদের করা সেই আইন এখন অনুশীলন করছে ভারত, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের গণতন্ত্রীয়নামী কর্তৃত্ববাদী সরকার। আর সেই মডেল ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার থেকে প্রাপ্ত।

ঔপনিবেশিক পূর্বসূরি থেকে সার্বভৌমত্বের একক মতাদর্শের সাথে সুনির্দিষ্ট ‘অনাচারী আইনের’ ধারাবাহিকতা বা পুনঃপ্রবর্তনের রদ করা দরকার। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো অসংখ্য অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত। এসব সমস্যা সৃজনশীলভাবে মিটমাট করার জন্য দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশে কাঠামোগত পরিবর্তন জরুরি। উপমহাদেশ জুড়ে শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য কূটনৈতিক অগ্রগতি অপরিহার্য।

ঔপনিবেশিক শাসনের কর্তৃত্ববাদী উত্তরাধিকার থেকে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর আবার রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিয়ে নতুন করে ভাবা দরকার।

আয়েশা জালাল: পাকিস্তানি-আমেরিকান ইতিহাসবিদ, আমেরিকার টাফ্টস ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক এবং সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ওশান স্টাডিজের পরিচালক

ইংরেজি থেকে ভাষান্তর - মুজাহিদুল ইসলাম

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মসজিদে ডুকে ইমামকে যুবদল নেতার বেধড়ক মারধর

রাইসির হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের পরও বেঁচে ছিলেন এক আরোহী

ছেলের আত্মহত্যায় মায়ের বিষপান

অপু বিশ্বাসের অভিযোগে ৩ জনকে সতর্ক করল পুলিশ

চট্টগ্রামে সোর্সের তথ্যে বেপরোয়া পুলিশ!

মেয়রের সামনে কাউন্সিলর রতনকে জুতাপেটা করলেন চামেলী

স্ত্রীর মরদেহ বিছানায়, ফ্যানে ঝুলছিলেন স্বামী

বদলির প্রায় দুই বছরেও কর্মস্থলে অনুপস্থিত তিনি

শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামে টেনিস বল গ্রাউন্ড নির্মাণকাজে অনিয়ম

বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের আহ্বান মহিলা ঐক্য পরিষদের 

১০

স্বাধীনতা ব্যাংকার্স পরিষদের সম্মেলন শুক্রবার

১১

ইঞ্জিনিয়ার পরিচয়ে বিয়ে, ডিভোর্স দিয়ে স্ত্রীর অন্তরঙ্গ ভিডিও ফেসবুকে

১২

বিএনপির হারানোর কিছু নেই : আমিনুল হক

১৩

টেকনাফে অপহরণ চক্রের প্রধান মোর্শেদ অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার

১৪

যাত্রীর ছুরিকাঘাতে অটোরিকশাচালক খুন

১৫

অটোরিকশা শ্রমিকদের অভিনন্দন শ্রমিক দলের

১৬

এটিএম বুথের সামনে মিলল মদ, অতঃপর...

১৭

‘জানাজায় যে শরিক হবেন তাকে ভোট দেবেন’

১৮

বনরক্ষীদের দেখে হরিণের মাংস ফেলে পালাল শিকারিরা

১৯

রাইসির মর্মান্তিক মৃত্যুতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর শোক

২০
X