বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভূমিকা চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের কাছে চিঠি লিখেছেন দেশটির ছয়জন কংগ্রেস সদস্য। তারা হলেন উইলিয়াম আর কিটিং, জেমস পি ম্যাকগভার্ন, বারবারা লি, জিম কস্টা, ডিনা টাইটাস ও জেমি রাসকিন। সবাই যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন দল ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ৮ জুন দেওয়া ওই চিঠিতে কংগ্রেস সদস্যরা বলেছেন, বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন এগিয়ে আসায় মানবাধিকার পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটছে। এটি নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জবাবদিহি নিশ্চিতে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ও অন্যান্য সংস্থার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।
এর আগে মার্কিন কংগ্রেসের অপর ছয় সদস্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে লেখা চিঠিতে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির সমালোচনা করেন। পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষ যাতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন, সে সুযোগ সৃষ্টির জন্য প্রেসিডেন্টকে ভূমিকা রাখার অনুরোধ জানান। এ জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে এবং দায়ী ব্যক্তিদের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের অনুরোধ করেন তারা। কংগ্রেসের এই ৬ সদস্য হলেন—স্কট পেরি, ব্যারি মুর, ওয়ারেন ডেভিডসন, বব গুড, টিম বার্চেট এবং কিথ সেলফ। এ ছাড়া ১২ জুন বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে ভূমিকা রাখতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেলকে একটি চিঠি লেখেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ছয় সদস্য। ওই চিঠিতেও বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়।
এ ধরনের চিঠি প্রদান নতুন কোনো ঘটনা নয়। তবে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সময়ে এমন প্রবণতা বেড়ে উঠেছে। চিঠি দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি ঠিক হয়ে যাবে বা ঠিক করা এত সহজ নয়। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, এ ধরনের চিঠির পেছনে বিরোধীদলগুলো অথবা লবিংয়ের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। এর পেছনে তাদের স্বার্থ জড়িত থাকার বিষয়টিকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
চিঠি আসবে এবং এটি থাকবে—এটা একটা প্রক্রিয়া। সর্বসম্প্রতিতে যে চিঠিটি প্রকাশিত হয়েছে তাতে স্বাক্ষরদানকারী ছয়জনকে বাংলাদেশের কেউ আদৌ চিনে কি না বা তারা আদৌ বাংলাদেশে কখনো এসেছেন কি না অথবা তারা কেউ বাংলাদেশ সম্পর্কে জানে কি না সন্দেহ রয়েছে। তারা চিঠি লিখতে পারেন। তাদের যেভাবে ব্রিফ করা হয়েছে সেই হিসেবে হয়তো তারা চিঠি লিখেছেন। কিন্তু যে বিষয়টা লক্ষণীয় তা হলো—সবগুলো চিঠিই ছয়জন ব্যক্তির পক্ষ থেকে লেখা হচ্ছে। কেন? ছয়জনের বেশি বা কম নয় কেন? এ বিষয়টাও খতিয়ে দেখা দরকার। তিনটি চিঠিই ছয়জন ছয়জন করে স্বাক্ষর করেছেন। ভাষাগুলো প্রায় একই রকম। এখান থেকে নানা প্রশ্ন ও সংশয় তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এসব চিঠি দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র বা রাজনীতি ঠিক করা যাবে না। যারা এসব উসকানি দিচ্ছেন তাদেরও আরেকটু সিরিয়াস হওয়া দরকার।
বাংলাদেশের রাজনীতি বা গণতন্ত্র ঠিক করতে হলে বাংলাদেশের জনগণকেই সেটি করতে হবে। কারও চিঠি বা স্যাংশন এক্ষেত্রে কাজ করবে না অতীত ইতিহাস তাই বলে। এ ধরনের চিঠি ও স্যাংশন বিভিন্ন দেশকে দেয়া হয়েছে। সেখানে সুফল মিলেছে বলে উদাহরণ নেই।
বাংলাদেশের জনগণ অনেক ত্যাগ স্বীকার করে এতদূর এসেছে। এটা ভুলে গেল চলবে না, একটা দেশ তার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের কারণে রীতিমতো জেনোসাইডের স্বীকার হয়েছে, প্রচণ্ড স্যাক্রিফাইস করেছে, প্রচুর ছাত্র ও মানুষ মারা গেছে। সেরকম একটা দেশ ছয়জন বিদেশি চিঠি দিয়ে কিছু বলবে আর বাংলাদেশের রাজনীতি ঠিক হয়ে যাবে, এটা সম্ভব না। এটা না বোঝার কোনো কারণ নেই। যদি তারা বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবধিকার বিষয়ে সিরিয়াস হয় তাদের উচিত হবে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা। বাংলাদেশের জনগণ প্রচণ্ড রাজনীতি সচেতন। সেই জায়গায় আরও মনোযোগ দেওয়া দরকার। এই ধরনের চিঠিপত্র বিভাজনটা আরও বাড়ায়। যে গণতন্ত্র তারা চাচ্ছে বা আমরা যারা গণতন্ত্রের কথা বলছি, যেই গণতন্ত্র আমরা ধারণ করি সেটা হতে হলে ন্যূনতম শর্ত হলো বড় বড় দলের মধ্যে আস্থা প্রতিষ্ঠা করা। এসব চিঠিতে আস্থা বাড়বে না। বরং বড় বড় দলের মধ্যে আরও অনাস্থা বাড়বে। এটা দলগুলোর মধ্যে বিভাজনকে আরও বাড়িয়ে দেবে। যত বেশি বিভাজন বাড়বে তারা যেই গণতন্ত্র চাচ্ছে সেটা কখনোই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে কীভাবে আস্থা বাড়ানো যায় সেখানেই দৃষ্টি দেয়া দরকার।
এই চিঠিপত্রে যেসব বার্তা রয়েছে তা সরকারি দল একভাবে নেবে, বিরোধী দল আরেকভাবে গ্রহণ করবে। বিরোধী দল হয়তো খুশি হবে। এই একই বিরোধী দল যদি সরকারি দলে থাকতো তখন তারা এটাকে অন্যভাবে নিত। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যানরা কেন এটা করছে এবং তাদের উদ্দেশ্য আমাদের জানা নেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদ্যমান বিভাজনটাকে আরও বাড়ালে হয়তো তাদেরই লাভ। কিন্তু এটা দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সমস্যা সমাধান হবে না। জনগণের ওপর আস্থা রাখতেই হবে।
বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়; লবিস্ট ছাড়া এটা হচ্ছে না। কংগ্রেসম্যানদের কেউ বাংলাদেশ নিয়ে গবেষণা করছে না। তাহলে এই চিঠিগুলো তারা কীভাবে দিচ্ছে। তারা আসলে কীসের সঙ্গে জড়িত? এগুলো খতিয়ে দেখা দরকার। এগুলো নিয়ে গণমাধ্যমের তদন্ত করে দেখা দরকার। দেখা দরকার যে তারা হঠাৎ করে বাংলাদেশ বিষয়ে কেন আগ্রহী হয়ে উঠল। তাদের যোগাযোগটা কী? এগুলো জানতে পারলে হয়তো তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছুটা বোঝা যাবে।
প্রতিটি চিঠির সারবস্তু হলো বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যদি গাজীপুরের মতো নির্বাচন হয়, তাহলে নির্বাচন নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন থাকছে না তাদের—এটি তাদেরই মন্তব্য। যুক্তরাষ্ট্র কারও বা কোনো নির্দিষ্ট দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণের ওপর জোর দিচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে সংবিধান পরিবর্তন করা তাদের দায়িত্ব না। তারা শুধু বলছে জনগণ যেন নিশ্চিতে ভোট দিতে পারে সেটাই তারা দেখবে।
সর্বশেষ আমার বক্তব্য স্পষ্ট। বিদেশিদের উপরে নির্ভর না করে সম্পর্কটা জনগণের সঙ্গে করা দরকার। বাংলাদেশে যত বড় বড় পরিবর্তন হয়েছে সব পরিবর্তনই হয়েছে জনগণ যখন রাস্তায় নেমেছে। লাখ লাখ জনগণ যখন রাস্তায় নেমেছে তখন পরিবর্তন হয়েছে। আন্দোলন ছাড়া কোনো পরিবর্তন হয়নি। আলোচনায়ও কিছু অর্জন হয়নি। তাই জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা দরকার। জনগণ যদি মনে করে পরিবর্তন দরকার তখন তারা রাস্তায় নামবে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র, রাজনীতি ও নির্বাচন বিষয়ে জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যান বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টের সদস্যদের চিঠি বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও রাজনীতির চর্চা উন্নত করতে কোনো ভূমিকাই রাখবে না।
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ : আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন