পবিত্র ঈদুল আজহার চাঁদ দেখা গেছে। আগামী ৭ জুন দেশে অত্যন্ত আনন্দমুখর পরিবেশে ঈদ উদযাপন হবে- সবাই এটাই আশা করছি। তথাপি এই ভাবনায় ছেদ পড়ে যাচ্ছে একটি কথা মনে করে, আর তা হচ্ছে- গাধার পিঠে উল্টো করে বসা নাসিরুদ্দিন হোজ্জার ভাস্কর্যের আদলে তৈরি করা একটি পাপেট এবারের ঈদুল ফিতরের আনন্দ মিছিলে বেশ আলোচিত এবং সমালোচিত হয়েছিল।
এই পাপেটের বিষয়ে প্রচলিত ভিন্ন ভিন্ন গল্পের মধ্যে যে গল্পটি বর্তমান সময়কে বার্তা দিচ্ছে তা হচ্ছে- একজন পথচারী হোজ্জাকে প্রশ্ন করলেন ‘মোল্লা তুমি যদি উল্টো করে বসো তাহলে কোথায় যাচ্ছো কি করে বুঝবে?’ জবাবে হোজ্জা বললেন, ‘আমি কোথায় যাচ্ছি সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমাকে দেখতে হবে আমি কোথা থেকে এসেছি এবং ফেলে আসা পথে কি কি ভুল করেছি। তাহলেই আমার ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি হবে না। আর ভুলের পুনরাবৃত্তি না হলেই কেবল সঠিক গন্তব্য দেখতে পাব।’
প্রসঙ্গক্রমে আলবার্ট আইনস্টাইনের যে উক্তিটি মনে পড়ছে তা হলো, ‘পৃথিবী একটি বিপজ্জনক জায়গা, যারা মন্দ কাজ করে তাদের জন্য নয়, বরং যারা তাকিয়ে থাকে এবং কিছুই করে না তাদের জন্য।’ আলবার্ট আইনস্টাইনের এই বিখ্যাত উক্তিটি অন্যায়ের মুখোমুখি ব্যক্তিদের নৈতিক দায়িত্ব পালনের গুরুত্ব মনে করিয়ে দেয়। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সমাজের ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিটি থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ চেয়ারে আসীন ব্যক্তিটিও সমানুপাতিক হারে দায়বদ্ধ। যখন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ তার স্বীয় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন তখন সাধারণ জনগণ নিজ কাঁধে দায়িত্ব তুলে নিতে বাধ্য হন।
সভ্যতার বিবর্তনে অর্থাৎ অন্ধকার যুগ থেকে আজকের এই আধুনিক যুগে প্রবেশের প্রতিটি বাঁকেই উপরোক্ত উক্তিটির যথার্থতা প্রমাণিত। আধুনিক যুগেও বিভিন্ন দেশের উত্থান-পতন ও রাষ্ট্র পরিচালনায় মৌলিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে রয়েছে এর প্রত্যক্ষ প্রভাব। ৬ জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ দেশ পরিচালনার দায়িত্বে থাকলেও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ ছিল। ফলে, ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে ঘটে যাওয়া অভ্যুত্থানে লাখো জনতার উপস্থিতি লক্ষণীয় ছিল।
যারা আন্দোলনে গিয়েছিল বা যারা বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক প্রতিবন্ধকতার কারণে আন্দোলনে যেতে না পারলেও আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করেছিল তারা কিন্তু কখনোই জানত না যে, আন্দোলন পরবর্তী বাংলাদেশ কেমন হবে? শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব কে গ্রহণ করবে? দল-মত নির্বিশেষে যখন আন্দোলনটি গণআন্দোলনে রূপ নিল তখনই সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে উঠলো। যদিও এখন অনেকে এটাকে গ্লোবাল পলিটিক্স এবং দেশের একটি ক্ষমতালোভী চক্রের সম্মিলিত চক্রান্ত প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। তবে, বৈশ্বিক অর্থনীতি, রাজনীতি, সমরনীতি ও কূটনীতিতে নিজেদের প্রভাব টিকিয়ে রাখা বা শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্য ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজস্ব কৌশল ব্যবহার করে থাকে।
তাই জুলাই আন্দোলনে বৈশ্বিক রাজনীতির প্রভাব যে ছিল না সে কথা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে, দেশের জনগণ যদি সরকারের পাশে থাকত তাহলে সরকার পতনের মতো পরিস্থিতি তৈরি করার কোনো কৌশল বা ষড়যন্ত্র যেটাই বলি না কেন সেটা সফল হতো না।
সরকার যে এই ১৫ বছরের অধিককাল শাসনামলে কোনো ইতিবাচক কাজ করেনি বিষয়টা এমন নয়। সরকার এই সময়ে অভূতপূর্ব ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধন করেছে। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিশাল উন্নতি হয়েছে এই সময়েই। কর্মসংস্থান বেড়েছে, জিডিপি বেড়েছে। সামাজিক সুরক্ষা নেটওয়ার্কের আওতায় মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, দরিদ্র ভাতা, অসহায় ভাতা, বিধবা ভাতা ও বয়স্ক ভাতার মতো সমাজতন্ত্রের মৌলিক চর্চাও হয়েছে। তথাপি সাধারণ জনগণ এমনকি সরকার দলীয় সমর্থকের একটা বিশাল অংশ কোন কারণে সরকার পতনের আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করেছিল?
এই প্রশ্নের উত্তর আলবার্ট আইনস্টাইনের উক্তিটির মধ্যে নিহিত রয়েছে। তার এই উক্তিটির মাঝে রয়েছে- মন্দ কর্ম বনাম নিষ্ক্রিয়তা এবং নৈতিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার প্রেক্ষিতে সম্মিলিত প্রতিক্রিয়া এবং যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার গুরুত্ব। সরকারে এমন কিছু ব্যক্তি ছিলেন যারা মন্দ কর্ম করেছেন এবং কিছু ব্যক্তি ছিলেন যারা এই মন্দ কর্ম দেখেও নিষ্ক্রিয় ছিলেন। মন্দ কর্মের দর্শকদের এই নিষ্ক্রিয়তা মন্দ কর্ম বা অন্যায় কাজগুলোকে স্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত করেছিল। ক্রমশ নিষ্ক্রিয় মানুষগুলোর একটা বৃহৎ অংশ এই মন্দ কর্মের অংশ হয়ে যাচ্ছিল। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিটি সভ্য মানুষ নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে ব্যক্তিগত জবাবদিহিতার পরিবেশ চাইবে।
যিনি বা যারা ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকেন এবং জনগণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নিয়ে যখন নিজেই অন্যায়কারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তখনই মজলুমকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হয়। আবার সরকার যখন নির্বিকারভাবে এই অন্যায়গুলো মেনে নেয় এবং প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তির উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করতে চেষ্টা করে তখন জনগণের মধ্যে এই সম্মিলিত প্রতিক্রিয়ার বিষয়টির জন্ম হয়।
আওয়ামী লীগ সরকার দেশের দৃশ্যমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখলেও জাতি হিসাবে নিজেদের স্বকীয়তা ও নৈতিকতা তৈরিতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। শেখ হাসিনা আওয়ামী মূল ধারার রাজনীতি অর্থাৎ অনেকটা বামপন্থি ঘরানার রাজনীতি দিয়ে শুরু করলেও ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর কিছুটা লিবারেল বামপন্থি অবস্থান নেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর তিনি ক্রমশ মধ্যপন্থি হয়ে যান। ডানপন্থিদের সাথে আঁতাত করে ক্ষমতায় থাকা যে তার কৌশলগত ভুল ছিল, তা এখন বোঝা যাচ্ছে। শেখ হাসিনা কিছুটা কর্তৃত্ববাদী ও একনায়কতান্ত্রিক ছিলেন। ২০১৪ এবং ২০১৮ তে একপক্ষীয় নির্বাচন করা যেমন আওয়ামী লীগের ভুল ছিল, তেমন সেই নির্বাচনে সর্বশক্তি নিয়ে অংশগ্রহণ না করাও বিএনপির কৌশলগত ভুল ছিল বলে আমি মনে করি।
বিএনপি যদি সর্বশক্তি নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করত, তাহলে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা দখলের নগ্ন জালিয়াতি আরও আগেই প্রকাশ পেত। ফলে তাদের পতন আরও আগেই হতো এবং সেই পতন বিএনপিকে ক্ষমতায় নিয়ে যেত, একটি অনির্বাচিত ক্রান্তিকালীন সরকারকে নয়। এক অর্থে আওয়ামী জোট রাতের নির্বাচন করে দেশের যতটা ক্ষতি করেছে, নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপিসহ অন্য কিছু দল কোনো অংশে কম ক্ষতি করেনি। একদিকে আওয়ামী লীগ দেশ ছাড়া হয়েছে; অপরদিকে বর্তমান বিএনপি ১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকার ফলে তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি সেই ২০০৫ সালের পূর্বের মতো মজবুত না হলেও বিশাল জনসমর্থন কিন্তু এখনো রয়েছে।
দলের প্রধান নেতাদের মাঝে সমন্বয়হীনতা ও সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তার যথাযথ বাস্তবায়নের অভাবে দলের শৃঙ্খলা অনেকটা ভেঙে পড়েছে। বিএনপি এ কথা স্বীকার করুক বা নাই করুক তৃণমূলে তাদের কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা এখনো সম্ভব হয়নি। তথাপি শেখ হাসিনা পতনের আন্দোলন সব নেতাকর্মীর মাঝে যে উদ্দীপনা, যে উৎসাহ ও আশার সঞ্চার করেছে অবিলম্বে তার সঠিক ব্যবহার করা না গেলে এবং সময়ের সাথে সাথে সঠিক কাজটি না করা গেলে এই জনসমর্থন কিন্তু হারিয়ে যাবে।
আমরা ঈদ আনন্দ মিছিলে হোজ্জার পাপেট দেখে কি সেই শিক্ষা নিতে পারব? যে শিক্ষা আমাদের শেখ হাসিনা সরকারের ভুলগুলোকে সংশোধন করতে বা এড়িয়ে চলতে শেখাবে। যারা পাপেটটি উপস্থাপন করেছেন তারা কি এই মর্ম বুঝবেন? নাকি শেখ হাসিনার দেখানো পথেই আবার আমাদের পতন হবে? পরিশেষে একটা কথাই বলতে চাই- প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধপরায়ণতা ন্যায়বিচারের অন্তরায়। নিরপেক্ষ থেকে অন্যায়কারীর বিচার করতে হবে। বিচারের আড়ালে প্রতিশোধপরায়ণতা এবং প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা হলে এবং দেশকে সেই বিভাজনের পথে নিয়ে গেলে কেবল আওয়ামী লীগের শুরু করা অনাচারের অসম্পূর্ণ বৃত্তটি পূর্ণতা পাবে।
ফলে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। জনগণের শক্তি যে বিশ্বের যে কোনো ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতার চেয়ে শতগুণ বেশি শক্তিশালী সেই মর্ম উপলব্ধি করে জনগণকে দেশপ্রেমের বন্ধনে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসতে এখন আমাদের একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক নেতার বড্ড বেশি প্রয়োজন। যার নেতৃত্বে প্রতিটি মানুষ বলতে শিখবে আমিই বাংলাদেশ।
থিয়েটার কর্মী
মন্তব্য করুন