

শহর ও উপশহরের জীবনে আটা আমাদের প্রতিদিনের খাবারের অপরিহার্য অংশ। সকালের নাশতা-রুটি থেকে শুরু করে বেকারির বিস্কুট, কেক কিংবা নুডলস সবখানেই আটার ব্যবহার অতি দ্রুত বেড়ে চলেছে। পরিবর্তিত জীবনধারা, নগরায়ণ, খাদ্যাভ্যাসের বৈচিত্র্য এবং খাদ্যশিল্পের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে আটাভিত্তিক খাবার আমাদের দৈনন্দিন জীবনে দৃঢ়ভাবে জায়গা করে নিয়েছে। ঠিক এই কারণে জনগণের সামগ্রিক পুষ্টির অভাব দূর করতে আটাকে ফর্টিফিকেশনের (অনুপুষ্টি সমৃদ্ধকরণ) উপযুক্ত বাহন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশে অনুপুষ্টির অভাব এক নীরব সংকট
মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট (অনুপুষ্টি) ঘাটতি, যাকে প্রায়ই ‘অনুপুষ্টির নীরব সংকট’ বলা হয়। বাংলাদেশে বহুদিন যাবৎ এটি একটি বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা। জাতীয় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সার্ভে (২০১৯-২০) অনুযায়ী, প্রজননক্ষম নারীদের ৪০ শতাংশের বেশি আয়রনের ঘাটতিতে ভুগছেন। ভিটামিন এ-এর ঘাটতিও এখনো উল্লেখযোগ্য হারে রয়েছে, শিশু ও নারীদের জন্য যা বিশেষ উদ্বেগের। অনুপুষ্টির ঘাটতি অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে, উৎপাদনশীলতা হ্রাস করে, শিশুর মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
আটা ফর্টিফিকেশন অর্থাৎ আয়রন, ফলিক অ্যাসিড, জিংক, ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন এ-সহ দশটি প্রয়োজনীয় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সংযোজন করে অনুপুষ্টির ঘাটতি দূরীকরণের একটি সহজ, সাশ্রয়ী ও ফলপ্রসূ সমাধান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে অ্যানিমিয়া ও নিউরাল টিউব ত্রুটি প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতিগুলোর একটি হিসেবে চিহ্নিত করেছে, বিশেষ করে যেসব দেশে আটার ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে।
বাংলাদেশের আটা বাজার : সম্ভাবনার এক বিস্তৃত ক্ষেত্র
বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৭ মিলিয়ন টন গম ব্যবহৃত হয়, যার ৬০-৭০ শতাংশ রূপ নেয় আটায়। দেশে ২৫০টিরও বেশি রোলার মিল এবং অসংখ্য আধা-স্বয়ংক্রিয় ও চাক্কি মিল রয়েছে, যা শিল্প কারখানা ও খুচরা বাজার উভয় ক্ষেত্রেই আটা সরবরাহ নিশ্চিত করছে। বিস্কুট, রুটি, বেকারি পণ্য, নুডলসসহ খাদ্যশিল্পের বৃহৎ পরিসরে ফর্টিফাইড (অনুপুষ্টি সমৃদ্ধ) আটার ব্যবহার এর সুফল কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দুর্লভ সুযোগ তৈরি করতে পারে। উচ্চ চাহিদা ও ক্রমবর্ধমান শিল্প কাঠামো সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশে বড় পরিসরে ফোর্টিফিকেশন বাস্তবায়নের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে।
সরকারি নীতি, মান ও বাস্তবতা
বাংলাদেশ খাদ্য ফর্টিফিকেশন কর্মসূচিতে ইতোমধ্যে প্রশংসনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। বিএসটিআই গমের আটায়/ময়দায় ১০টি মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সংযোজনের মান নির্ধারণ করেছে, যা আন্তর্জাতিক নির্দেশনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। জাতীয় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ফর্টিফিকেশন স্ট্র্যাটেজি এবং খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ আটার ফোর্টিফিকেশনকে একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় উদ্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
বাংলাদেশে লবণ ও ভোজ্য তেলে ফর্টিফিকেশন আইন ও বিএসটিআইর মানদণ্ড অনুযায়ী বাধ্যতামূলক, তবে আটা/ময়দা ফর্টিফিকেশন বাস্তবায়ন কার্যক্রম এখনো বিএসটিআইর মানদণ্ড অনুযায়ী ঐচ্ছিক। বিশ্বের ৯০টিরও বেশি দেশে যেমন অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইন্দোনেশিয়া, কেনিয়া ও ফিলিপাইনসহ আটার বাধ্যতামূলক ফর্টিফিকেশন জনস্বাস্থ্যে সুস্পষ্ট ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। বাংলাদেশেও স্কুল ফিডিং ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ফর্টিফাইড আটা অন্তর্ভুক্ত হলে গ্রহণযোগ্যতা দ্রুত বৃদ্ধি পাবে।
সামাজিক কল্যাণ ও ব্যাবসায়িক সম্ভাবনা
ফর্টিফিকেশন শুধু জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নই নয়, এটি ব্যবসার জন্যও একটি বড় সুযোগ। স্বাস্থ্যসচেতন ভোক্তার সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে, ফলে ফর্টিফাইড আটার একটি বিশ্বাসযোগ্য ও প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। খুচরা বাজারে ফর্টিফাইড আটা প্রিমিয়াম পণ্য হিসেবে স্থান করে নিতে পারে। পাশাপাশি এনজিও, স্কুল, বেকারি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারত্ব তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করবে। উন্নয়ন সংস্থাগুলো স্থানীয় মিলগুলোর প্রযুক্তি উন্নয়ন, মান নিয়ন্ত্রণ এবং ডিজিটাল ট্রেসিবিলিটি ব্যবস্থায় সহায়তা দিচ্ছে, যা ফর্টিফিকেশন শিল্পকে আরও আধুনিক করে তুলছে।
প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন
বাংলাদেশে ফর্টিফিকেশন প্রযুক্তির বৈপ্লবিক উন্নয়ন হচ্ছে। স্বয়ংক্রিয় মাইক্রো-ডোজিং সিস্টেম নির্দিষ্ট মাত্রায় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট যুক্ত করতে সক্ষম। বাংলাদেশে ক্লাউড-ভিত্তিক মনিটরিং সিস্টেমের পাইলট কার্যক্রম চলছে, যা কার্যকারিতা ও গুণগতমানের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে।
ফর্টিফিকেশনকে এসডিজি-২ (ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব), এসডিজি-৩ (সুস্বাস্থ্য) এবং এসডিজি-১২ (দায়িত্বশীল উৎপাদন) এর সঙ্গে যুক্ত করা গেলে আন্তর্জাতিক তহবিল, সহযোগিতা এবং রপ্তানি সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পেতে পারে।
উদ্যোগ ও অগ্রগতি
আন্তর্জাতিক কোয়ালিশন মিলার্স ফর নিউট্রিশন ২০২৪ সালে টেকনোসার্ভের পরিচালনায় বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। এ উদ্যোগ গমের আটা-ময়দা, চাল ও ভোজ্য তেল ফর্টিফিকেশনকে উৎসাহিত করছে। কারিগিরি প্রশিক্ষণ, মিলারদের স্বীকৃতি প্রদান ও প্রযুক্তিগত সহায়তার মাধ্যমে ফর্টিফাইড খাদ্যের মানোন্নয়ন ও ভোক্তার আস্থা অর্জনে সহায়তা করছে।
এসিআই ফুডস্ ২০২৫ সালে প্রথমবারের মতো এসিআই পিওর ‘পাওয়ার’ ফর্টিফাইড আটা বাজারে আনে, যা বাংলাদেশের প্রথম বৃহৎ স্কেল ব্র্যান্ডেড ফর্টিফাইড আটা। ইফাদ মাল্টি প্রডাক্ট লিমিটেড ২০২৪ সালের শেষ দিকে তাদের ফর্টিফাইড আটা বাজারজাত শুরু করে। বর্তমানে প্যাকেটজাত ফর্টিফাইড আটার বাজার প্রতি মাসে প্রায় ৩০০ টন এবং তার চাহিদা দ্রুত বাড়ছে।
পথচলার দিকনির্দেশনা
বাংলাদেশে আটা-ময়দার ফর্টিফিকেশনের সুযোগ অসীম। তবে এর সফল বাস্তবায়নে প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ। নীতিনির্ধারকদের বাধ্যতামূলক ফোর্টিফিকেশনের দিকে অগ্রসর হওয়া, উন্নয়ন সহযোগীদের প্রযুক্তিগত ও বাজার-উদ্দীপনা অব্যাহত রাখা এবং মিলারদের ফর্টিফিকেশনকে ব্যয় নয় বরং মানবসম্পদ উন্নয়ন ও ব্র্যান্ড নির্মাণের বিনিয়োগ হিসেবে দেখা। দেশের অর্ধেক আটা যদি ফর্টিফাইড করা যায়, তাহলে অনুপুষ্টির অভাবজনীত রোগ প্রতিরোধ, বিপুল চিকিৎসা ব্যয় সাশ্রয় এবং আরও সুস্থ-উৎপাদনশীল জাতি গঠন সম্ভব।
আটা ফর্টিফিকেশন শুধু একটি পুষ্টি উদ্যোগ নয়, বরং এটি বাংলাদেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির এক বাস্তব-অবারিত সম্ভাবনা।
লেখক : মো. গুলজার আহম্মেদ, কান্ট্রি প্রোগ্রাম ম্যানেজার, টেকনোসার্ভ বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন