বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে লন্ডনে অনুষ্ঠেয় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকটি উভয়ের জন্য সুযোগ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে সৃষ্ট সংকট কেটে যেতে পারে। অন্যদিকে রাজনীতিবিদদের প্রত্যাশা, দেশের রাজনীতি ও নির্বাচনের দিনক্ষণের ধোঁয়াশা কেটে যাবে। দেশের রাজনীতিতে সুবাতাস বইবে।
তারেক রহমান ও ড. ইউনূসের মধ্যে অনুষ্ঠিতব্য বৈঠক নিয়ে বুধবার (১১ জুন) কালবেলার সঙ্গে আলাপকালে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন তারা।
শুক্রবার (১৩ জুন) লন্ডনের স্থানীয় সময় সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টার মধ্যে হোটেল ডোরচেস্টারে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। বৈঠকটি ঘিরে সবার দৃষ্টি এখন লন্ডনের দিকে। বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা থেকে শুরু করে সকল স্তরের নেতাকর্মীরাও লন্ডন বৈঠকের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। সবার প্রত্যাশা, এই বৈঠক থেকে একটা ইতিবাচক ফল বেরিয়ে আসবে। আর এই বৈঠকের পরেই বিএনপি তাদের পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, গোটা জাতি এখন লন্ডনের দিকে তাকিয়ে। বিশ্বাস করি, এটি হবে ঐতিহাসিক বৈঠক এবং এ বৈঠকের মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে সুবাতাস বইবে। তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে ডিসেম্বরে নির্বাচনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছে বিএনপি। যৌক্তিক সময়েই নির্বাচন হবে বলে জাতি প্রত্যাশা করে। আলোচনার মধ্য দিয়ে নির্বাচনসহ সকল সমস্যার সমাধান সম্ভব।
১২ দলীয় জোটের প্রধান ও জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার কালবেলাকে বলেন, দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠেয় বৈঠকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতি ও নির্বাচনের দিনক্ষণের ধোঁয়াশা কেটে যাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
তিনি বলেন, ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকে পতিত স্বৈরাচারের উসকানি এবং সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে; আশা করছি- এই বৈঠকের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু সমাধান আসবে।
সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, ড. ইউনূস এবং তারেক রহমানের বৈঠকে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে বিশদ আলোচনা হবে। এই বৈঠক দেশের জন্য সুবাতাস নিয়ে আসবে বলে আমরা আশাবাদী।
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের আহ্বায়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ কালবেলাকে বলেন, বিএনপি ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটসহ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও জোট চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন চায়। নির্বাচনমুখী প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ডিসেম্বরই উপযুক্ত সময়। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার আগামী বছরের এপ্রিলে নির্বাচন করতে চান। অথচ রমজান, আবহাওয়াসহ নানা কারণে নির্বাচনের জন্য এপ্রিল উপযুক্ত সময় নয়। ফলে ওই সময়ে নির্বাচন হওয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এমন অবস্থায় লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। দেশবাসী এখন এই বৈঠকের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমরা মনে করি, এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে। নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে সৃষ্ট সংকটও কেটে যেতে পারে। সর্বোপরি দেশের গণতন্ত্রে উত্তোরণের পথ আরও সহজ হতে পারে।
ন্যাশনাল লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা লায়ন মো. ফারুক রহমান আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক দেশে গণতন্ত্রের পথ উন্মোচন করবে। রাষ্ট্রের ভিত্তি আরো সুদৃঢ় হবে এবং নির্বাচন নিয়ে জনমনে যে প্রশ্ন উঠেছে, তা কেটে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, সংস্কারের বিষয়ে সরকারের অবস্থান, নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ, নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা, দেশকে স্থিতিশীল রাখা, বিএনপির সাথে সরকারের কোনো দূরত্ব নেই অর্থাৎ একটা ঐক্য অবস্থা প্রকাশ করা- এগুলো সবই এখন সরকারের জন্য প্রয়োজন। তাছাড়া এই অন্তর্বর্তী সরকারকে বিদ্যমান অবস্থা থেকে বের হয়ে একটা নির্বাচিত স্বাভাবিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নিতে হবে। এমন অবস্থায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথে শুক্রবার অনুষ্ঠেয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সামনে নির্বাচন হলে বিএনপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। সুতরাং এই সরকারের জন্য সেই দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের মনোভাবটা বুঝা দরকার। যদিও ঢাকায় বিএনপির প্রতিনিধি দলের সাথে সরকারের একাধিক বৈঠক হয়েছে। তবে তাদের কেউ দলটির হাইকমান্ড নন। হাইকমান্ডের সাথে কথা বলা আর অন্যদের সাথে কথা বলা এক রকম না। সেই জায়গা থেকে বলতে গেলে সরকার একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, তাছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার যেসব কাজ করতে চান অর্থাৎ তারা দৈনন্দিন কাজ পরিচালনা করছেন, তারা জাতিকে একটি অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে চান, পাশাপাশি সংস্কার ও গণহত্যার বিচারেরও উদ্যোগ নিয়েছেন- এগুলো করার ক্ষেত্রেও সরকারের বিএনপির সহযোগিতা দরকার। কারণ, বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় দল। তাই সরকারের জন্য বিএনপির সহযোগিতা চাওয়া, বিএনপির সাথে বোঝাপড়ায় আসা খুব দরকার। এককথায় সরকারের সাফল্যের জন্যও বিএনপির সহযোগিতা প্রয়োজন।
রাজনৈতিক এই বিশ্লেষক বলেন, সরকার উদ্যোগ নিলেও এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে বিএনপির জন্যও একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। নির্বাচনের তারিখ ও সংস্কারের ব্যাপারে সরকারের সাথে দলটির যে একটু মতবিরোধ আছে, পাশাপাশি গণহত্যার বিচার- এসব ইস্যুতে তারা কী চায়, সেটা কীভাবে করতে চায়-এ ক্ষেত্রে আলোচনা করে সরকারকে বিএনপির মনোভাবটাও বোঝাতে পারে। এর মধ্য দিয়ে দু’পক্ষেরই কাছাকাছি আসা সম্ভব।
দেশে নির্বাচন নিয়ে কোনো সংকট তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন না কাজী মাহবুবুর রহমান। তার মতে, এটা তারিখের ব্যাপার। এমন নয় যে, সরকার এপ্রিলের প্রথমার্ধের কথা বললেও ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে নির্বাচন হতে পারবে না। সরকার তো এর আগে জুন পর্যন্ত সময়ের কথা বলেছিলেন। সরকার মনে করলে আবার ফেব্রুয়ারির কথাও বলতে পারেন।
তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচনের যে তারিখ চাচ্ছে, সেটা তো বাস্তবসম্মত। সরকার দ্রুত নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চাইলে আগামী ডিসেম্বর, জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনটা শেষ করতে হবে। না হলে একাধিক কারণে অন্য সময়ে নির্বাচন করাটা কঠিন হবে। আর সরকার যদি মনে করেন, তারা আরো এক বছর কিংবা বেশি সময় ক্ষমতায় থাকতে চান এবং সেটার প্রয়োজন আছে, তাহলে নির্বাচনটা ২০২৬ সালের ডিসেম্বর কিংবা তার পরের জানুয়ারিতে চলে যাবে। এসব নিয়ে বিএনপির সাথে সরকারের চূড়ান্ত পর্যায়ের আলোচনা হওয়া দরকার। সেজন্য তারেক রহমানের সাথে অনুষ্ঠেয় প্রধান উপদেষ্টার এই বৈঠক হবে উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম। সেদিক থেকে বলতে গেলে, এই বৈঠক উভয় পক্ষের জন্য একটা সুযোগ, উদ্যোগ যেই নিক না কেন।
ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্যেরও একটা সূচনা হচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে একটা বার্তাও যাচ্ছে যে, বিএনপি ও সরকার পথ চলছে একসাথে। না হলে তো তারা বসতো না। আর বসার মানেই হলো এখানে একটা ইতিবাচক দিক আছেই।
মন্তব্য করুন