দুর্বল অর্থনীতির দোহাই দিয়ে গ্রামীণ, সুবিধাবঞ্চিত, আদিবাসী ও ভূমিহীন নারীদের জন্য বিনিয়োগ কোনোভাবেই ছেঁটে ফেলা যাবে না, বরং বাজেটে তাদের জন্য বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে। শনিবার (৯ মার্চ) রাজধানীর আসাদ এভিনিউ-এ (মোহাম্মদপুর) ১৩টি মানবাধিকার ও নাগরিক সংগঠনের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত এক মানববন্ধনে বক্তারা এ দাবি জানান।
‘নারীর সমঅধিকার, সমসুযোগ- এগিয়ে নিতে চাই পর্যাপ্ত বিনিয়োগ’ এই প্রতিপাদ্য এবং ‘চাই ভূমি-কৃষিতে নারীর পূর্ণ অধিকার, মজুরিসহ সব ক্ষেত্রে সমঅধিকার, অন্যায্য বৈষম্য হোক পরিহার’- এই স্লোগানকে সামনে রেখে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন উপলক্ষে মানববন্ধনটি আয়োজন করে এএলআরডি, বেলা, নিজেরা করি, বাদাবন সংঘ, আরবান, ব্লাস্ট, আইপিডিএস, কাপেং ফাউন্ডেশন, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন, এনডিএফ, নাগরিক উদ্যোগ, বারসিক ও তৃণমূল উন্নয়ন সংস্থা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রায় দেড়শ নারী-পুরুষ এতে অংশ নেন।
মানবন্ধনে এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, রাষ্ট্রের আইন, নীতিমালা ও আন্তর্জাতিক আইনে নারীর সমান অধিকারের কথা থাকলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন নেই বললেই চলে, বরং বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। তিনি বলেন, বৈষম্যমূলক আইন পরিবর্তন করতে হবে। কৃষিতে নারীর অধিকার, নারী কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি, কৃষিকার্ড প্রাপ্তি, বিনাশর্তে বা সহজ শর্তে স্বল্প সুদে গ্রামীণ ও সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জন্য ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। ভূমিহীন, দরিদ্র, বস্তিবাসী, গ্রামীণ, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু, দলিত নারীসহ সব নারীর সমান অধিকার, বিশেষ করে ভূমি, উত্তরাধিকার, সম্পদ, কর্ম, মজুরি ও কৃষি ক্ষেত্রে সমঅধিকার, সমসুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
সংহতি বক্তব্যে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, বাংলাদেশ সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপের ফলে নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ ও নির্যাতন বন্ধে বেশ কিছু আইন-নীতিমালা প্রণীত হলেও আমাদের দেশে নারীরা এখনো চরম বৈষম্য, নিপীড়ন ও সহিংসতার শিকার। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আগেও নারীর অংশগ্রহণ ছিল অপ্রতুল, এখন কিছুটা বাড়লেও তা পর্যাপ্ত নয়।
তিনি বলেন, স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়সহ সমাজের সর্বস্তরে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক, কর্তৃত্ববাদী ও সামন্তবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। নারীর অধিকার, মানবাধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে।
নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু বলেন, নারীর অধিকার, ভূমি ও কৃষিতে নারী অধিকার ও সর্বস্তরে নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। দেশের স্বাধীনতায় নারীর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ, তাদের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব ছিল না। নারীকে পেছনে ফেলে, বঞ্চিত রেখে, নারীর সঙ্গে বৈষম্য করে, নারীর গৃহস্থালি-কৃষি-শিল্প-অর্থনৈতিক অবদানকে অস্বীকার করে কোনো দেশ এগিয়ে যেতে পারে না, পারবেও না। তাই আমাদের নারীর অবদানের স্বীকৃতি দিতে হবে।
উত্তরবঙ্গের বিএমডিএ-র সেচ প্রকল্পের সেচ পাম্প অপারেটররা সবাই পুরুষ এবং তাদের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দুজন কৃষক আদিবাসী কৃষক আত্মহত্যা করেছেন উল্লেখ করে রাজশাহীর বেসরকারি সংস্থা রুলফাও-এর নির্বাহী প্রধান আফজাল হোসেন বলেন, তাদের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির জন্য তারা নারী কৃষকদের মূল্যায়ন করতে চান না। ডিপ পাম্প অপারেটর নিয়োগের ক্ষেত্রে নারীদের প্রাধান্য দেয়া, ধর্মীয় জলসা বা সভায় নারী বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, ওয়াজ বন্ধ করা এবং উত্তরাধিকার আইনের সংস্কার ও বাস্তবায়ন করে ভূমিতে ও উত্তরাধিকারে নারীর প্রাপ্য অংশ নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি।
এতে অন্যদের মধ্যে সংহতি বক্তব্য দেন- এনডিএফ-এর প্রধান নির্বাহী ইবনুল সাঈদ রানা, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক তানিয়া খাতুন, বেলা’র আইনজীবী হাসানুল হক বান্না, পাবনার নারী কৃষক শরীফা আক্তার নিপা, বরিশাল থেকে আসা জোবেদা বেগম ও রেহানা খাতুন, গ্রিন বাংলা গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সুলতানা বেগম, সিরাজগঞ্জ থেকে আসা হোসনে আরা জলি প্রমুখ।
আয়োজক সংস্থাসমূহ সম্মিলিতভাবে দেশের সব নারীর জন্য ১৯টি দাবি তুলে ধরে একটি লিফলেট প্রচার করে। দাবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সব প্রকার ভূমি আইন, নীতিমালা, প্রবিধান বাতিল করতে হবে; শর্তহীনভাবে গ্রামীণ জনপদের নারীদের খাসজমি দিতে হবে; খাসজমি নীতিমালার অগ্রাধিকার তালিকা থেকে বিধবা নারীর ক্ষেত্রে সক্ষম পুত্র সন্তানের শর্ত বাতিল করতে হবে; সিডও সনদের অনুচ্ছেদ ২ এবং ১৬.১(গ)-এর ওপর সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে কমিটির সুপারিশসমূহ বাস্তবায়ন করতে হবে; সহজ শর্তে এবং অগ্রাধিকারভিত্তিতে আদিবাসী নারীসহ সব নারী কৃষকদের সরকারি কৃষিসেবা, প্রযুক্তি সেবা, ভর্তুকি, কৃষিঋণ, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি পাওয়ার সুযোগ দিতে হবে; পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে ইত্যাদি।
মন্তব্য করুন