মার্কিন নৌবাহিনীর সবচেয়ে আলোচিত বিশেষ কমান্ডো দল ‘নেভি সিল টিম ৬’। ২০১৯ সালের শীতের এক অন্ধকার রাতে উত্তর কোরিয়ার উপকূলে নেমেছিল এক গোপন মিশনে। উদ্দেশ্য ছিল উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং-উনের ফোনালাপ আড়ি পেতে শোনার মতো একটি বিশেষ যন্ত্র স্থাপন করা। কিন্তু নিখুঁত পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ভেস্তে যায় পুরো অভিযান।
এতটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল মিশনটি যে সরাসরি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল। ব্যর্থ হলে ভিয়েতনামে ট্রাম্প-কিম বৈঠক ভেস্তে যেতে পারত। এমনকি মার্কিন সেনারা জিম্মি হওয়ার আশঙ্কাও ছিল প্রবল।
সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস বেশ কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান মার্কিন কর্মকর্তা এবং সেনা সদস্যের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই ব্যর্থ অভিযানের বিস্তারিত প্রকাশ করেছে।
অজানার দেয়াল ভাঙার চেষ্টা
উত্তর কোরিয়া বরাবরই মার্কিন গোয়েন্দাদের জন্য দুর্ভেদ্য এক দুর্গ। ট্রাম্প যখন কিম জং-উনের সঙ্গে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে আলোচনা শুরু করেন, তখন কিমের ব্যক্তিগত অবস্থান ও ভাবনা বোঝা জরুরি হয়ে পড়ে ওয়াশিংটনের কাছে। তাই কিমের কথোপকথন সরাসরি ধরতে উত্তর কোরিয়ায় ইলেকট্রনিক ডিভাইস বসানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এই দায়িত্ব দেওয়া হয় ‘রেড স্কোয়াড্রন’ ইউনিটকে, যারা আগে ওসামা বিন লাদেন হত্যার অভিযানে অংশ নিয়েছিল।
পরিকল্পনা ছিল— একটি পারমাণবিক সাবমেরিন উত্তর কোরিয়ার কাছে অবস্থান নেবে। সেখান থেকে দুটি মিনি-সাবমেরিনে কমান্ডোরা উপকূলে পৌঁছে যন্ত্রটি বসাবে এবং নিরাপদে ফিরে আসবে। কিন্তু বড় বাধা ছিল, উত্তর কোরিয়ার ভেতরের পরিস্থিতি সম্পর্কে খুব সামান্য তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল। স্যাটেলাইটের কয়েক মিনিট অন্তর তোলা ছবি ছাড়া অন্য কোনো গোয়েন্দা সহায়তা ছিল না।
ভুলের সূত্রপাত
কঠোর প্রস্তুতির পর ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে দলটি রওনা হয়। ট্রাম্প ভিয়েতনামে কিমের সঙ্গে বৈঠকে বসার আগ মুহূর্তেই তিনি অভিযানের চূড়ান্ত অনুমোদন দেন।
কমান্ডোরা যখন মিনি-সাবমেরিনে চড়ে উপকূলের মাত্র ১০০ গজ দূরে পৌঁছায়, তখনই ঘটে প্রথম ভুল। একটি সাবমেরিন অতিরিক্ত কাছে চলে গিয়ে ঘুরিয়ে আনতে সময় নষ্ট হয়। এতে দুই সাবমেরিন বিপরীত দিকে মুখ করে অবস্থান নেয়।
সদস্যরা ডাইভিং সরঞ্জাম খোলার সময় অজানা থেকে যায় যে কাছেই ছিল একটি ছোট মাছ ধরার নৌকা। শীতের রাতে রাবার স্যুট পরা জেলেদের শরীর নাইট-ভিশনের থার্মাল সেন্সরে ধরা পড়েনি।
অভিযান আরও জটিল হয়ে ওঠে যখন সাবমেরিন ঘোরানোর শব্দ বা ককপিটের আলো দেখে নৌকাটি তাদের দিকে এগিয়ে আসে। টর্চলাইট জ্বালিয়ে পানিতে খোঁজাখুঁজি শুরু করে জেলেরা। উপকূলে থাকা সিল সদস্যরা বুঝতেই পারছিলেন না, এরা সাধারণ জেলে নাকি নিরাপত্তা বাহিনী।
গুলির শব্দে ভেস্তে যায় মিশন
পরিস্থিতি চরম অনিশ্চিত হয়ে ওঠে যখন নৌকা থেকে একজন জেলে পানিতে ঝাঁপ দেন। তখন সিনিয়র সদস্য গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। মুহূর্তেই নিহত হন অন্তত দু-একজন বেসামরিক মানুষ। পরে কাছে গিয়ে দেখা যায়, তারা কেবল শামুক শিকার করছিলেন, কারও কাছেই অস্ত্র ছিল না।
অভিযান ব্যর্থ জেনে দ্রুত লাশগুলো পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। এরপর জরুরি সংকেত পাঠানো হলে মূল সাবমেরিন ঝুঁকি নিয়ে উপকূলের কাছে এসে কমান্ডোদের উদ্ধার করে আন্তর্জাতিক জলসীমার দিকে ছুটে যায়।
পরিণতি ও রহস্য
পরে মার্কিন স্যাটেলাইট উত্তর কোরীয় সেনাদের বাড়তি তৎপরতা শনাক্ত করলেও পিয়ংইয়ং প্রকাশ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তারা আদৌ জানত কি না যে এটি মার্কিন সেনাদের কাজ— সেটি আজও রহস্য।
কয়েক দিন পর ভিয়েতনামে ট্রাম্প-কিম বৈঠক কোনো চুক্তি ছাড়াই শেষ হয়। এর অল্প সময়ের মধ্যেই উত্তর কোরিয়া আবার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা শুরু করে এবং তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি আরও দ্রুত এগিয়ে যায়। বর্তমানে দেশটির হাতে প্রায় ৫০টি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
মন্তব্য করুন