দক্ষিণ এশিয়া থেকে শুরু করে পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ এমনকি আমেরিকা— বিশ্বজুড়ে এখন এক অদ্ভুত রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। শাসকগোষ্ঠীর দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য, চাকরির অভাব এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে ‘জেন জি’ প্রজন্মের তরুণরা দলে দলে রাজপথে নেমে পড়ছে। তাদের আন্দোলনের জোয়ারে ইতোমধ্যেই কয়েকটি সরকার পতন ঘটেছে, আশঙ্কার মধ্যে রয়েছে আরও অনেক দেশ।
শ্রীলঙ্কা : অস্থিরতার সূচনা
এই ধারাবাহিক আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল শ্রীলঙ্কা থেকে। ২০২২ সালে দেশটিতে জ্বালানি, খাদ্য ও ওষুধ সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করে। দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন সাধারণ মানুষ। তরুণদের নেতৃত্বে লাখো মানুষ প্রেসিডেন্ট ভবন ঘেরাও করে। টিকতে না পেরে পালিয়ে যান প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসা। এটি দক্ষিণ এশিয়ায় সরকার পতনের এক যুগান্তকারী সূচনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ : কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে সরকার পতন
২০২৪ সালে বাংলাদেশও রাজনৈতিক অস্থিরতায় জড়িয়ে পড়ে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন দ্রুত রূপ নেয় ব্যাপক সরকারবিরোধী বিক্ষোভে। দুর্নীতি, মুদ্রাস্ফীতি ও দমননীতির বিরুদ্ধে জেন-জি প্রজন্ম সবচেয়ে বেশি সরব হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নেপাল : ছাত্রদের নেতৃত্বে পরিবর্তন
বাংলাদেশের আন্দোলনের প্রভাব পড়ে নেপালেও। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তুলে আন্দোলনে নামে। অচিরেই এই আন্দোলন বিক্ষোভের ঝড়ে পরিণত হয়। তীব্র চাপের মুখে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
ভারত : অস্থিরতার সঙ্কেত
ভারতে এখনো সরকার পতন হয়নি, তবে পরিস্থিতি উত্তপ্ত। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কঠোর আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা চালু করেছেন। তারপরও চাকরিপ্রত্যাশী তরুণদের আন্দোলন ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। বিশেষ করে বিহারে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়ম ও বঞ্চনার অভিযোগে হাজার হাজার তরুণ রাস্তায় নেমেছে। মোড়ান সম্প্রদায়ের বিক্ষোভ যোগ হওয়ায় আন্দোলন আরও বিস্তৃত আকার নিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, ভারতের অস্থিরতা যদি দমন না করা যায় তবে তা সরকার পরিবর্তনের পথে নিয়ে যেতে পারে।
ফিলিপাইন থেকে ইন্দোনেশিয়া : পূর্ব এশিয়ার অস্থিরতা
শুধু দক্ষিণ এশিয়াই নয়, পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও তরুণদের বিক্ষোভ চলছে। ফিলিপাইনে অবকাঠামো প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে রাজপথ উত্তপ্ত। পূর্ব তিমুর ও ইন্দোনেশিয়ায় মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের কারণে তরুণরা বিক্ষোভ করছে। সরকারগুলো সেনা ও পুলিশ নামালেও আন্দোলনের ঢেউ ঠেকানো যাচ্ছে না।
লাতিন আমেরিকা ও ইউরোপে অস্থিরতা
পেরুতে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে, এবার তরুণদের আন্দোলনে তা আরও ঘনীভূত হয়েছে। ইউরোপেও ফ্রান্স ও সার্বিয়ায় ‘জেন জি’ প্রজন্ম সরব হয়েছে। ফ্রান্সে অর্থনৈতিক সংস্কার ও চাকরির অনিশ্চয়তা নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে, আর সার্বিয়ায় দুর্নীতি ও নির্বাচনী কারচুপির অভিযোগে তরুণরা রাস্তায় নেমেছে।
যুক্তরাষ্ট্রেও তরুণদের চাপ
বিশ্বশক্তি যুক্তরাষ্ট্রও এ তরঙ্গ থেকে মুক্ত নয়। সামাজিক বৈষম্য, শিক্ষাঋণের বোঝা এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে সরকারের ভূমিকা নিয়ে তরুণরা ব্যাপকভাবে প্রতিবাদ করছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে রাজপথে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আসন্ন নির্বাচনে এ আন্দোলনের প্রভাব পড়তে পারে।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি কেবল কোনো অঞ্চলের সমস্যা নয়, বরং এক বৈশ্বিক প্রজন্মগত বিদ্রোহ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবাদের স্লোগান ছড়িয়ে পড়ছে মুহূর্তেই। তরুণ প্রজন্ম দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে এক অভিন্ন ভাষায় প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
বিশ্বের বিভিন্ন সরকার এখন এক অনিশ্চয়তার ভেতরে। কে কখন ক্ষমতা হারাবে, তা বলা কঠিন। তবে এতটুকু নিশ্চিত— ‘জেন জি’ ঝড়ে বিশ্ব রাজনীতির মানচিত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে চলেছে।
মন্তব্য করুন