দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যাত্রাকাল থেকেই জন্মলাভ করে নানা আলোচনা-সমালোচনা। পাঁচ বছর আগে আইনটি কার্যকর হওয়ার পর বিভিন্ন সময় আইনটির অপপ্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে, জন্ম দিয়েছে অনেক বিতর্কিত ঘটনার। বিভিন্ন সময় নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ হয়েছেন হয়রানির শিকার। বিশেষভাবে সংবাদমাধ্যম বা গণমাধ্যমকর্মীরা তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেনই, এ আইনের অপপ্রয়োগে সার্বিকভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি। ফলে আইনটির বাতিল বা সংশোধন প্রশ্ন এখন জোরালো হয়ে উঠেছে।
আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি, আইনটির অপপ্রয়োগের বিষয়টি আমলে নিয়ে বিভিন্ন সময় খোদ আইনমন্ত্রী এবং সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল জায়গা থেকেও বারবার এটি সংশোধনের কথা বলা হয়েছে। সোমবার জাতীয় সংসদে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আবারও বিষয়টির পুনরোক্তি করেছেন। তিনি বলেছেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রোধ বা গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়নি। সাইবার অপরাধ দমনের জন্যই এই আইন করা হয়েছে। তবে এর অপব্যবহার যাতে না হয়, সেজন্য সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে কেবল দেশের মানুষই নয়, অনেক প্রভাবশালী দেশ ও সংগঠন এ বিষয়ে বিভিন্ন সময় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এখনো করে চলেছে। সোমবার সংসদে আইনমন্ত্রীও সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর থেকে এই আইন নিয়ে পাঠানো ‘টেকনিক্যাল নোট’-এর কথা উল্লেখ করেছেন। এটার পর্যালোচনাও প্রায় শেষ এবং দ্রুত আইনটির সংশোধনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন তিনি।
আমরা সবাই জানি, দেশে এই আইনের যথেচ্ছ ব্যবহার ও অপব্যবহার সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে করেছে ক্ষুণ্ন। এমনকি কখনো কখনো রাজনৈতিক মহলের ইশারায় এবং নাগরিকের মৌলিক অধিকারহরণের হাতিয়ার হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন সময় আমরা এ-ও দেখেছি, কোনো ব্যক্তিকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে অথবা নির্দিষ্ট কোনো সম্প্রদায়ের ওপর চড়াও হতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই আইনের বিপক্ষে যায় এমন কোনো কথাবার্তা বা স্ট্যাটাস দেওয়া হয়েছে। এর পরিণতি কতটা ভয়াবহ হয়েছে—তা সবার জানা। ফলে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, সেসব ঘটনায় অনেক নিরীহ মানুষকে শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে এ আইনটির কারণে। এভাবে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। ফলে এই আইন বাতিল অথবা সংশোধন করে জনকল্যাণকর করার দাবি উঠেছে সব মহল থেকে।
আমরা মনে করি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের অধিকার সমুন্নত রাখতে এই আইন নিয়ে বিশেষ ভাবনা-চিন্তার ও উপযুক্ত পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি। তবে সেক্ষেত্রে দেশের সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার বিষয়টিকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিতে হবে। যেহেতু এই আইনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি গণমাধ্যমের ওপর এবং গণমাধ্যমকর্মীরাই বারবার এর শিকারে পরিণত হয়েছেন, সুতরাং সাংবাদিক নেতাসহ এ বিষয়ে দেশের অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গেরও কাজটিতে সংযুক্ত করাই বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত হবে। তাদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিয়ে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণ হবে—এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।
মন্তব্য করুন