প্রায় দেড় বছর মন্দার পর দেশের পুঁজিবাজারে প্রাণ ফিরতে শুরু করেছে। শেয়ারদরের সর্বনিম্ন মূল্যসীমা বা ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়ার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সক্রিয় হয়েছে। বাজারও তার স্বাভাবিক নিয়মে ওঠানামা করছে। অন্যদিকে এতদিন ব্যক্তি বিনিয়োগকারীর অনেকেই মুখ ফিরিয়ে থেকেছে। এখন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সক্রিয় হওয়ার খবর পেয়ে ওই বিনিয়োগকারীরাও ফের ফিরে আসতে শুরু করেছেন। তদুপরি দৈনন্দিন লেনদেনে শেয়ারের মূল্যও নিয়মিত ও পরিমিত সংশোধন হচ্ছে। এতে ধীরে ধীরে গতিশীল হচ্ছে পুঁজিবাজার।
বাজার-সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, কারসাজি রোধ এবং আইন ও বিধিবিধানের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে পুঁজিবাজারের এ গতিশীলতাকে আগামীতেও ধরে রাখা সম্ভব হলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থাও বাড়বে, যা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই করবে বাজারকে।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ১৮ জানুয়ারি ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের পরের কার্যদিবস ২১ জানুয়ারি থেকে পরবর্তী ৬ কার্যদিবস পর্যন্ত প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান মূল্যসূচক ২৫৭ পয়েন্ট হারিয়ে ৬ হাজার ৭৯ পয়েন্টে নেমে আসে। তবে পরবর্তী সময়ে পর্যাক্রমে সূচকের ধারাবাহিক উত্থানে গতকাল পর্যন্ত ২৪৩ পয়েন্ট যুক্ত হয়ে ৬ হাজার ৩২২ পয়েন্টে অবস্থান নিয়েছে। এ সময় লেনদেনে টাকার পরিমাণ, শেয়ার সংখ্যা ও অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এমনকি গত দেড় বছরে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। অন্যদিকে ফ্লোর প্রাইস থাকাকালীন সময়ে লেনদেন কমে ২০০ কোটির নিচে নেমে আসে। বছর ও মাসের হিসাবে দৈনন্দিন গড় লেনদেন (টার্নওভার) ৪০০ থেকে ৫০০ কোটির মধ্যে ঘোরাফেরা করছিল। এর প্রভাবে অনেক ব্রেকারেজ হাউস দেউলিয়া হয়ে পড়ে। অনেক বিনিয়োগকারীর পুঁজিও আটকে যাওয়ায় তারা চরম হতাশায় ছিল। এমন অনিয়মতান্ত্রিক বাজারে আস্থার অভাবে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও অদৃশ্য হয়ে পড়েন। মুলত ফ্লোর প্রাইস দিয়ে বাজারের স্বাভাবিক গতি আটকানোর কারণে এ দৈন্য ভাব পরিলক্ষিত হয়।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী কালবেলাকে বলেন, ফ্লোর প্রাইস দেওয়া মানেই ছিল বাজারকে বন্ধ ঘোষণা করা। যার মাধ্যমে গত দেড় বছর ভালো শেয়ারের লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে জাঙ্ক শেয়ার কেনা-বেচার দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। সেখানে কারসাজি হয়েছে। শুধু জাঙ্ক শেয়ারের লেনদেন হয়েছে বলেই এমনটি হয়েছে। এখন দেরিতে হলেও বাজার থেকে সর্বনিম্ন মূল্যসীমা তুলে নেওয়ার কারণে প্রথমদিকে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও এখন কিন্তু স্বাভাবিক লেনদেন হচ্ছে। টার্নওভারও বাড়ছে। এতে মনে হচ্ছে, মার্কেট প্লেয়াররা (বাজার মধ্যস্থতাকারীরা) সচ্ছলতার সঙ্গে তাদের প্রতিষ্ঠান চালাতে পারবেন। দ্বিতীয়ত মূল্যসীমা তুলে নেওয়ার পর বাজার এখন পর্যন্ত কোনো নেতিবাচক রূপ দেখায়নি। তবে আরও কিছুদিন বাজারকে দেখা দরকার। একই সঙ্গে বাজারে আস্থা তৈরির জন্য নীতি সহায়তা দরকার। কারণ এখন মুদ্রা বাজার খুব টাইট অবস্থায়। চলছে তারল্য সংকট। এতকিছুর পরও বলব, শেয়ারবাজারটা ভালো চলছে।
বাজার পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, বাজারকে যত কম নিয়ন্ত্রণ করা যায় ততই ভালো। নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের কাজ হচ্ছে, বাজারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মাধ্যমে শেয়ার কেনা-বেচা নিশ্চিত করা।
জানা গেছে, শেয়ারের দরপতন ঠেকাতে ২০২২ সালের ২৮ জুলাই তালিকাভুক্ত সব কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিটের ওপর প্রথম ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। ব্যবস্থাটি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় সাময়িক বলা হলেও এর পরে কেটে যায় দীর্ঘ দেড় বছর। অবশ্য ওই বছরের ২১ ডিসেম্বর ১৬৭টি কোম্পানির ওপর থেকে ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার করা হলেও ২০২৩ সালের ১ মার্চ থেকে ফের ফ্লোর প্রাইস আরোপ করা হয়। এর মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবসহ সার্বিকভাবে শেয়ারবাজারের কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে আসে। ফলে নির্বাচনের আগে-পরে বাজার-সংশ্লিষ্ট ও বিশ্লেষক পর্যায় থেকে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার দাবি ওঠে। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের পর নতুন সরকার ও মন্ত্রিসভা গঠনের পর ১৮ জানুয়ারি ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত আসে।
ওই দিন ৩৫ কোম্পানি ছাড়া বাকি সব কোম্পানির ওপর থেকে ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার করা হয়। পরে ২২ জানুয়ারি আরও ২৩ কোম্পানি থেকে ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার করা হয়। এখন আর বাকি ১২টি কোম্পানি। তবে ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার হলেও এখনো বহাল আছে শেয়ারের সার্কিট ব্রেকার।
ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী কালবেলাকে বলেন, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা, যারা নির্বাচনের আগে দূরে সরে গিয়েছিল, তারা এখন ফিরে আসছে। নতুন আইপিও আসছে। এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আগ্রহ দেখা দিয়েছে। কারণ, নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে। এখন ডলারের বাজারটা যদি কমে আসে এবং বিশ্বসমাজে কোনো বড় ঘটনা না ঘটে, আশা করছি বাজার ভালো থাকবে। বাজার যেহেতু ভালো করছে, সেক্ষেত্রে বাকি যে ১২ কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস আছে, সেটি প্রত্যাহার করা দরকার।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের পর বাজার ভালো করছে। তবে শেয়ারবাজারের মূল সমস্যা হচ্ছে, নতুন ভালো কোম্পানির বাজারে না আসা। নতুন কোম্পানি তো আসছে না। সূচক ৬ হাজার ২০০-৩০০-এর মধ্যে ঘুরছে। এ অবস্থায় শেয়ারবাজারকে গতিশীল বলতে নারাজ তিনি।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, আন্তর্জাতিক শেয়ারবাজারের সঙ্গে আমাদের শেয়ারবাজারের সম্পর্ক খুব কম। এডিবি, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ সবাই বলছে, ২০২৪ সালের প্রবৃদ্ধি কমবে। অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়েও উদ্বেগ আছে। আছে কিছু অনিশ্চয়তাও। এগুলো ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশের জন্য সন্তোষজনক নয়। কাজেই অদূরভবিষ্যতে শেয়ারবাজার খুব একটা ভালো হবে বলে তিনি মনে করেন না।