যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে প্রতিদিন গড়ে ৫৬০ টন খাবার গাজায় প্রবেশ করছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। তবে এ ত্রাণ এখন পর্যন্ত গাজার দুর্ভিক্ষপীড়িত উত্তরাঞ্চলে পৌঁছায়নি। ইসরায়েলের সঙ্গে থাকা গাজার দুটি প্রধান সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ থাকা, যুদ্ধবিধ্বস্ত সড়ক এবং উত্তরাঞ্চলের প্রধান ত্রাণ রুটগুলোয় ক্রমাগত বাধার কারণে এ মানবিক সাহায্য গাজা শহরের মতো সবচেয়ে সংকটাপন্ন এলাকায় পৌঁছানো অসম্ভব হয়ে পড়ছে বলে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
গাজা সিটিতে দুর্ভিক্ষ চলার কথা এর আগে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছিল। সংস্থাটির মানবিকবিষয়ক প্রধান টম ফ্লেচার জানিয়েছেন, অপুষ্টি, গৃহহীনতা ও অবকাঠামোর চরম সংকটের মোকাবিলা করতে প্রতি সপ্তাহে হাজার হাজার ত্রাণবাহী গাড়ির প্রবেশ প্রয়োজন। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির মুখপাত্র আবির এতেফা জেনেভায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা এখনো প্রয়োজনীয় স্তরের নিচে আছি, তবে আমরা সেখানে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি। যুদ্ধবিরতি ত্রাণ সরবরাহের জন্য একটি ‘সংকীর্ণ জানালা’ খুলে দিয়েছে এবং ডব্লিউএফপি খাদ্য সহায়তা বাড়াতে খুব দ্রুত এবং দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে।’
তবে সংস্থাটি এখনো গাজা সিটিতে ত্রাণ বিতরণ শুরু করতে না পারার কথাও জানিয়েছে, যার মূল কারণ হিসেবে তারা ইসরায়েলের সঙ্গে থাকা গাজার দুটি সীমান্ত ক্রসিং—জিকিম ও ইরেজের বন্ধ থাকাকে দায়ী করেছে। এ ক্রসিং দুটি গাজার উত্তরাংশে অবস্থিত, যেখানে মানবিক বিপর্যয় সবচেয়ে তীব্র। এতেফা জানান, গাজা সিটি এবং উত্তর গাজায় প্রবেশ করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। তার মতে, ভূখণ্ডের দক্ষিণ থেকে আটা ও প্রস্তুত করা খাবারের পারসেল ভর্তি কনভয়গুলোর চলাচল যুদ্ধে বিধ্বস্ত হওয়া অথবা অবরোধ করে রাখা সড়কের কারণে ব্যাহত হচ্ছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘উত্তরাঞ্চলে এ রুটগুলো খুলে দেওয়া খুবই জরুরি, কারণ এখানেই দুর্ভিক্ষ জেঁকে বসেছে। এ দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করতে হলে এ পথগুলো খোলা থাকা অত্যন্ত জরুরি।’
যদিও ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে তীব্রতম ও সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ হয়েছে যে এলাকায়, সেই উত্তরাঞ্চলে সামান্য পরিমাণে পুষ্টি পণ্য পৌঁছেছে, তবে ত্রাণ কনভয়গুলো এখনো উল্লেখযোগ্য পরিমাণে খাদ্য সেখানে নিতে পারেনি। এতেফা বলেন, ‘সর্বশেষ এক দিনে দক্ষিণ ও মধ্য গাজায় আমাদের ৫৭টি ট্রাক ঢুকেছে। আমরা একে একটি অগ্রগতি মনে করি, তবে আমরা এখনো দিনে প্রায় ৮০-১০০ ট্রাকের স্তরে পৌঁছাইনি।’
জাতিসংঘের মানবিকবিষয়ক সমন্বয় কার্যালয় ওসিএইচএ জানিয়েছে, মধ্যস্থতাকারীদের কাছে ইসরায়েলের সামরিক সাহায্য সংস্থা কোগ্যাটের দেওয়া তথ্য অনুসারে, বৃহস্পতিবার কেরেম শালোম ও কিসুফিম ক্রসিং দিয়ে গাজায় প্রায় ৯৫০টি ট্রাক প্রবেশ করে। এর আগের দিন বুধবার, জ্বালানি ও গ্যাস বহনকারী ১৬টি ট্রাকসহ প্রায় ৭১৫টি ট্রাক গাজায় ঢুকেছিল। কিন্তু এ বিপুল পরিমাণ খাদ্যের বেশিরভাগই উত্তরাঞ্চলে পৌঁছাতে পারছে না, ফলে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছানো নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
জাতিসংঘের নারী অধিকার সংস্থা ইউএন উইমেন জানিয়েছে, গাজায় খাদ্য, ওষুধ এবং বিশেষ করে নারী ও মেয়েদের জন্য সুরক্ষাসামগ্রীর প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। সংস্থাটির কর্মকর্তা সোফিয়া ক্যালটর্প বলেন, ‘যুদ্ধবিরতি হয়তো লড়াই থামিয়েছে; কিন্তু সংকটের অবসান ঘটায়নি। ১০ লাখেরও বেশি নারী ও মেয়ের খাদ্য সহায়তা প্রয়োজন এবং প্রায় সোয়া দুই লাখের জরুরি পুষ্টি সহায়তা দরকার।’
গাজাগামী ত্রাণ আটকে দিচ্ছে কট্টরপন্থি ইসরায়েলিরা: সংকটের মধ্যেই কট্টরপন্থি ইসরায়েলিদের একটি গোষ্ঠী কেরেম শালোম ক্রসিংয়ে গাজাগামী মানবিক সহায়তার ট্রাকগুলোকে বাধা দিচ্ছে বলে জানিয়েছে আলজাজিরা। গোষ্ঠীটি সামাজিকমাধ্যমে দেওয়া পোস্টে জানিয়েছে, তারা ক্রসিংয়ের পথে বিভিন্ন পয়েন্টে ট্রাকগুলোকে বাধা দিচ্ছে। তাদের দাবি, হামাস চুক্তি লঙ্ঘন করছে এবং জিম্মিদের মৃতদেহ ফিরিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে, তাই তাদের পুনর্গঠনে সাহায্য করে এমন ত্রাণ বন্ধ করা উচিত। তারা আরও বলছে, শেষ জিম্মির মৃতদেহটি ফিরে না আসা পর্যন্ত কোনো ত্রাণবাহী ট্রাক যেতে পারবে না। এই চরমপন্থি গোষ্ঠীটি একটি ভিডিও পোস্ট করেছে যেখানে তাদের সদস্যদের একটি ত্রাণবাহী ট্রাককে বাধা দিতে দেখা যাচ্ছে।
টাইমস অব ইসরায়েলের এক প্রতিবেদন অনুসারে, এ গোষ্ঠীটি ইসরায়েলি গণহত্যার সময়ও ক্রসিংগুলোর দিকে যাওয়া রাস্তা বন্ধ করে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে এবং কিছু ক্ষেত্রে ত্রাণের চালান লুট বা ক্ষতি করে গাজায় ত্রাণ সরবরাহে বারবার বাধা দেয়। যুদ্ধবিরতি চুক্তির অধীনে, হামাস প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি বন্দির বিনিময়ে ২০ জন জীবিত ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে এবং আরও ১০ জন বন্দির মৃতদেহ হস্তান্তর করেছে।
হামাস জানিয়েছে, তারা বাকি ইসরায়েলি বন্দিদের মৃতদেহ উদ্ধারে কাজ করছে। তবে সেগুলো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ায় উদ্ধারে বড় আকারের খননযন্ত্র গাজায় ঢুকতে দেওয়া প্রয়োজন।
যুদ্ধবিরতি চুক্তির অন্য শর্তগুলোকে বাস্তবায়নে জোর দিতে মধ্যস্থতাকারীদের প্রতি আহ্বান হামাসের: এদিকে, ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তির বাকি শর্তগুলো বাস্তবায়নের জন্য মধ্যস্থতাকারী দেশ মিশর, কাতার ও তুরস্কের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে হামাস চুক্তির শর্ত অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরিমাণে ত্রাণ গাজায় প্রবেশ, রাফাহ ক্রসিংয়ের উভয় দিক খুলে দেওয়া এবং উপকূলীয় এলাকাটির পুনর্গঠন শুরু করার দাবি জানিয়েছে। গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য গত দুই বছর ধরে মিশর, কাতার ও তুরস্কের ‘আন্তরিক প্রচেষ্টার’ জন্য হামাস তাদের প্রতি ‘গভীর কৃতজ্ঞতা’ও প্রকাশ করেছে।
মন্তব্য করুন