পৃথিবীর বুকে কাঠ দিয়ে নির্মিত বিভিন্ন স্থাপনার মধ্যে এক অনন্য উদাহরণ ইরানের রাজা ভি খোরাসান প্রদেশের নিশাপুর (স্থানীয় উচ্চারণে নিসাবর) এলাকার ছোবিন গ্রামে অবস্থিত একটি কাঠের মসজিদ। মুসলমান অধ্যুষিত ইরানের প্রায় ৯ কোটি মানুষের পাশাপাশি জ্ঞান ও ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে ‘নিশাপুর কাঠের মসজিদ’ নামে এই এবাদতখানার পরিচিতি রয়েছে।
নানা কারণে ইরানের খোরাসান এলাকাটি বিশেষ তাৎপর্যময়। মুসলিম বিশ্বের বহু প্রখ্যাত মানুষের জন্ম, লেখাপড়া ও গবেষণার জন্য এই এলাকাটি বিশেষভাবে সমৃদ্ধ। অষ্টাদশ দশকের শেষ ভাগে ইরানের অন্যতম ধর্মীয় গুরু ছিলেন আখন্দ খোরাসানি। তারই সুযোগ্য নাতি হামিদ মুস্তাহেদির হাত ধরে নির্মিত হয় নিশাপুর কাঠের মসজিদ।
প্রচলিত ইতিহাস মতে, নিশাপুর এলাকায় ভূমিকম্পের সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে সম্পূর্ণ কাঠ দিয়ে এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। তাই পৃথিবীর বুকে প্রথম ভূমিকম্প সহনীয় এবাদতখানা রূপেও মসজিদটির পরিচিতি রয়েছে। ২০০ বর্গমিটার এলাকা জুড়ে নির্মিত মসজিদের দুপাশে দুটি মিনার রয়েছে। প্রতিটি মিনারের উচ্চতা ১২ মিটার (প্রায় ৪০ ফিট), যার প্রতিটি নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে চার টন করে কাঠ। আর পুরো মসজিদ নির্মাণে ৪০ টন কাঠ ব্যবহৃত হয়েছে।
মসজিদের ভেতরে নানা আকারের ও বিচিত্র বর্ণের কাঠ খণ্ডের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। স্থানীয় গাছগাছালির নানা আকৃতির পাতার আদলে পাতলা কাঠের টুকরো কেটে কেটে কিছু দেয়াল সাজানো হয়েছে। আবার ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি ও পবিত্র কোরআনের বাণী গ্রথিত হয়েছে দেয়ালে ব্যবহৃত কিছ কিছু কাঠের ওপর। শুধু দেয়ালই নয়, মসজিদের দরজা, জানালা, সিঁড়ি এমনকি মেঝেও নির্মিত হয়েছে কাঠ দিয়ে। দরজার হাতল ও খিলানে ব্যবহৃত কাঠে রয়েছে অপূর্ব কারুকাজ।
মসজিদের ওপরে এবং পেছনেও কাঠের কিছু ঘর নির্মিত হয়েছে। কাঠের বেঞ্চ, কাঠের বুকশেলফ ও অন্যান্য কাঠের আসবাবপত্র দেখে ধারণা করা যায় যে, জ্ঞান অর্জন ও জ্ঞান বিতরণের জন্য এসব কাঠের ঘর ব্যবহৃত হতো। মসজিদের চারপাশের বাগানের বেড়াও নির্মিত হয়েছে কাঠ দিয়ে। মসজিদে পাশ দিয়ে একটি সরু জলাধার রয়েছে, যা দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। আগেরকার দিনে অজুর জন্য এই পানি ব্যবহৃত হতো।
নিশাপুর গ্রামে মসজিদের আশপাশে বেশ কিছু কাঠের ঘরবাড়ি রয়েছে। ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য মসজিদ ও এসব ঘরবাড়ির আদি রূপ ধরে রাখা হয়েছে। তবে বৈদ্যুতিক আলোর সুপরিকল্পিত ব্যবহার পুরো এলাকার সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এ সৌন্দর্য ও স্থানীয় জাদুঘর দেখতে সব ধর্মের মানুষের পদভারে সারা বছর মুখরিত থাকে এ নিশাপুর কাঠের মসজিদ।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত মেজর। গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট