শরীয়তপুরের নড়িয়া-জাজিরা সংযোগ সড়কের কীর্তিনাশা নদীতে ভাষাসৈনিক গোলাম মাওলা সেতুর নির্মাণকাজ দীর্ঘদিনেও শেষ না হওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন যাতায়াতকারী ও স্থানীয় বাসিন্দারা। ৭ বছরে দুই দফায় ঠিকাদার পরিবর্তন করেও সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ করতে পারেনি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। এ ছাড়া পুরোনো সেতুটিও ভেঙে ফেলায় ছয় মাস ধরে এ পথ দিয়ে চলাচলকারীদের ঝুঁকি নিয়ে ট্রলারে নদী পার হতে হচ্ছে।
গতকাল শুক্রবার সরেজমিন নড়িয়া কীর্তিনাশা নদীর তীরে গিয়ে দেখা যায়, নির্মাণাধীন সেতুর কাজ বন্ধ। নদীর পূর্ব পাড়ে ভায়াডাক্টের কিছু অংশ নির্মাণ করা হয়েছে, আর পশ্চিম তীর ও নদীতে আটটি পিলার করা হয়েছে। ওই পথে চলাচলকারী লোকজন ট্রলার দিয়ে নদী পারাপার হচ্ছেন। দুটি ট্রলার লাগাতার যাত্রী পারাপার করলেও প্রতিটি ট্রলারেই অতিরিক্ত ভিড়। সময় বাঁচাতে অসংখ্য মানুষ চাপাচাপি করে উঠছেন।
শরীয়তপুর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, নড়িয়া উপজেলা সদরের পশ্চিম পাশ দিয়ে কীর্তিনাশা নদী প্রবাহিত হয়েছে। নদীর পূর্ব তীরে উপজেলা সদর এবং পশ্চিম তীরে মোক্তারের চর, রাজনগর, নশাসন ও জপসা ইউনিয়ন। এ ছাড়া জাজিরা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নও রয়েছে। নড়িয়া উপজেলা সদরের সঙ্গে সড়কপথে ওই ইউনিয়নগুলো এবং জাজিরার যোগাযোগের জন্য ১৯৯৭ সালে কীর্তিনাশা নদীর ওপরে ১০৫ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি সেতু নির্মাণ করে এলজিইডি। ২০১০ সাল থেকে কয়েক বছর সেতুটির আশপাশ থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও নদীভাঙনের কারণে সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। ২০১৫ সালে সেতুটি ব্যবহারের অনুপযোগী ঘোষণা করা হয়। ওই সময় থেকে সেতু দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয় স্থানীয় প্রশাসন।
২০১৭ সালে ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৪৫ মিটার সেতু নির্মাণ করার জন্য নাভানা কনস্ট্রাকশন নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ওই প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করলেও কয়েক মাস পর তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২০১৯ সালে সেতুটির নির্মাণকাজ ফেলে প্রতিষ্ঠানটি চলে যায়। তখন ওই প্রতিষ্ঠানকে ৩ কোটি ৪২ লাখ টাকা বিল পরিশোধ করা হয়। এরপর ২০২১ সালে ফের দরপত্র দেওয়া হয়। এ দফায় সেতুটির সঙ্গে ভায়াডাক্ট যুক্ত করে এর দৈর্ঘ্য বাড়ানো হয়। ২৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০৫ মিটার সেতু ও ২২২ মিটার ভায়াডাক্টের নির্মাণকাজ পায় কোহিনুর এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তারা ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর কার্যাদেশ পায়। গত ৯ জুন প্রতিষ্ঠানটির কাজের মেয়াদ শেষ হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত ৫০ শতাংশ কাজ শেষ করেছে। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা বিল বাবদে তুলে নিয়েছে।
নড়িয়া পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সাদিকা কালবেলাকে জানায়, ‘প্রতিদিন স্কুলে ক্লাস ও প্রাইভেট পড়ার জন্য তিন-চারবার উপজেলা সদরে যাওয়া-আসা করতে হয়। ট্রলারে করে পার হতে হচ্ছে। মাঝেমধ্যে নদী পার হওয়ার সময় বৃষ্টিতে ভিজে স্কুল ড্রেসসহ বই-খাতা ভিজে যায়। এ ছাড়া ট্রলারে নদী পার হতে অনেক ভয় করে।’
কীর্তিনাশা নদীর উত্তর পাড় মোক্তারেরচরের বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন আকন কালবেলাকে বলেন, ‘এখান দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক চলাচল করে। অনেক দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী, স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা। এটার কারণে নড়িয়া বাজারের ব্যবসায়ীরা অনেক ক্ষতির মধ্যে আছে। তাদের বেচাকেনা কমে গেছে। স্কুল কলেজের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে যায় না। তাদের পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
এ বিষয়ে কোহিনুর এন্টারপ্রাইজের পক্ষে সেতুটির নির্মাণকাজ করছেন আবদুল ওয়াহাব মাতবর নামে এক ব্যবসায়ী। তার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি কালবেলাকে বলেন, হাতে টাকা নেই। খয়রাত করতেছি।
বিষয়টি নিয়ে এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম রাফেউল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘২০১৭ সালে যে ঠিকাদার নিযুক্ত করা হয়েছিল, তিনি কাজটি শেষ না করে চলে যান। এলজিইডি ওই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। এখন যে ঠিকাদার কাজ করছেন, তারাও ধীরগতিতে কাজ করছে। তাদের কাজের গতি বাড়াতে একাধিকবার তাগিদপত্র দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিকল্প একটি ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছে। তা আগামী দুই মাসের মধ্যে সম্পন্ন করার চেষ্টা করা হচ্ছে।’