আতাউর রহমান
প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৫৮ এএম
আপডেট : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:২২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ঘটনা সব সত্য অনেক আসামি প্রশ্নবিদ্ধ!

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন
ঘটনা সব সত্য অনেক আসামি প্রশ্নবিদ্ধ!

মুন্সীগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ৪ আগস্ট নিহত হন দিনমজুর রিয়াজুল ফরাজী ও নুর মোহাম্মাদ। ওই ঘটনায় স্বজনরা থানায় পৃথক দুটি হত্যা মামলা করেন। এতে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীসহ কয়েকশ আসামির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আসামির তালিকায় রয়েছেন গজারিয়া উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহ আলম মোল্লা ও তার ভাই উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ঈমন আহমেদ সবুজ মোল্লাসহ পরিবারের ছয়জন।

অথচ সবুজ মোল্লা বলছেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শুরু থেকেই তিনি রাজধানীর রাজপথে সক্রিয় ছিলেন। পুলিশের হামলায় আহতও হন। তার পুরো পরিবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। পূর্বশত্রুতার জেরে তৃতীয়পক্ষের উসকানিকে তাদের আসামি করা হয়েছে বলে দাবি তার।

গত ১৯ জুলাই ছাত্র আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর বাড্ডায় নিহত হয়েছিলেন তৌফিকুল ইসলাম। ওই ঘটনায় ২১ আগস্ট বাড্ডা থানায় করা মামলায় ১১৩ জন আসামির তালিকায় রয়েছেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান নগর-পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম ও উত্তরার একজন ব্যবসায়ী শেখ মো. রুহুল আমিন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যবসায়ী রুহুল আমিন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। আসামির তালিকায় থাকা রাজউক কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম বলেন, একটি চক্র তাকে পদ থেকে সরে যাওয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছিল। তা না করায় হয়রানি করতে হয়তো তাকে আসামি করা হয়েছে।

২০ জুলাই বিকেলে সাভার বাজার সংলগ্ন এলাকায় গুলিতে নিহত হন নুর মোড়ল (৫২) নামে এক ব্যক্তি। ৪ আগস্ট তার স্ত্রীর করা মামলায় এজাহারভুক্ত ১২৫ আসামির মধ্যে ৯৭ নম্বর আসামির তালিকায় রয়েছেন সাভারের ভাকুর্তা এলাকার জুলহাস। এজাহারে তার পরিচয় দেওয়া হয়েছে ৭নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। কিন্তু জুলহাস বলছেন, তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি তো দূরের কথা, জীবনে কোনো রাজনীতিই করেননি। ক্ষুদ্র ব্যবসা করে সংসার চালান।

নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক গত ফেব্রুয়ারিতে দেশে এসেছিলেন। এরপর থেকে অবস্থান করেন গ্রামের বাড়ি গাজীপুরে। ছাত্র আন্দোলনে নিহতের ঘটনায় গাজীপুরের গাছা থানার এক মামলায় ৫০ নম্বর আসামির তালিকায় রয়েছেন তিনিও! ওই একই মামলার ৭০ নম্বর আসামি জয়দেবপুর ১ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেনও। তার পুরো পরিবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। গাছা থানার আরেকটি হত্যা মামলায় আসামি হয়েছেন গাজীপুর জেলা বিএনপির সাবেক সদস্য ফারুক হোসেন। তিনি একজন ব্যবসায়ী।

গত জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত

ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে পতিত শেখ হাসিনার সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি দলীয় কর্মীদের দিয়ে নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যা করেছে। ৫ আগস্ট থেকে গত এক মাসে এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শতাধিক মামলা হয়েছে। তবে এসব মামলায় ঢালাওভাবে আসামি করা হচ্ছে। নির্বিচারে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো সত্য হলেও ঢালাওভাবে আসামি করায় মামলাগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। ‘নির্দোষ’ ব্যক্তিদের আসামি করায় নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞ ও পুলিশের সাবেক কর্মকর্তারা।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরেও এ ধরনের মামলা করে বিরোধী মতের লোকজনকে হয়রানি করার অসংখ্য নজির রয়েছে। তখন ঘটনা কেউ দেখেনি-শুনেনি, এমন বিষয়েও কাল্পনিক কাহিনি সাজিয়ে এজাহার হতো। এই মামলাগুলো গায়েবি মামলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে গুলি করে হতাহতের ঘটনায় গত ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত দায়ের হওয়া মামলাগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থী ছাড়াও বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের আসামি করা হচ্ছিল। এসব মামলার বেশিরভাগই বাদী ছিল পুলিশ। যদিও ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এসব মামলার অনেকগুলোই প্রত্যাহার করেছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার।

ছাত্র-জনতাকে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখন স্বজনরাই বাদী হয়ে মামলা করছেন। তবে এসব মামলায় ঘটনাস্থলে ছিলেন না, দেশে ছিলেন না এমন ব্যক্তিদেরও আসামি করা হচ্ছে। সর্বশেষ গত ৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় আক্কাস আলী হত্যাকাণ্ডে দায়ের হওয়া মামলায় আওয়ামী লীগ, অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী ও পুলিশের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করা বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের নামও আসামির তালিকায় উঠে এসেছে, যা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। মামলাগুলোতে শত শত আসামির নাম থাকলেও তাদের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা থাকায় সন্দেহ সৃষ্টি হচ্ছে। বাদীকে এসব নাম-ঠিকানা কেউ সংগ্রহ করে দিচ্ছেন কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে।

বেশ কয়েকটি মামলার বাদীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারাও সব আসামিকে চেনেন না। পরিচিতজন, ঘটনাস্থলের আশপাশের বিভিন্ন দলের নেতাকর্মী এবং নানা মাধ্যমে তারা আসামির নাম পেয়ে ব্যবহার করছেন বলে তাদের অনেকেই জানিয়েছেন।

এসব মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুরুল হুদা কালবেলাকে বলেন, গণহারে আসামি করার পর যদি তাদের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করা না যায়, তাহলে মামলাগুলো দুর্বল হবে। চার্জশিট হলেও সম্পৃক্ততা না পাওয়া গেলে সাজা নিশ্চিত হবে না। এতে মামলাগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে।

ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার জোতির্ময় বড়ুয়া কালবেলাকে বলেন, তারাও বেশকিছু এজাহার বিশ্লেষণ করে দেখেছেন ঢাকার হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সময় অন্য জেলায় অবস্থান করছিলেন, এমন লোকজনও আসামি করা হয়েছে। ধরে ধরে এক জেলার লোক অন্য জেলার ঘটনায় মামলায় এজাহারভুক্ত করা হচ্ছে। সবকিছু ধরে মনে হচ্ছে, নাম বাণিজ্য শুরু হয়েছে। মামলার ন্যায়বিচারের স্বার্থে এই বাণিজ্যকারীদের থামানো দরকার। না হলে মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে। তিনি বলেন, পুলিশ যদি সঠিক তদন্ত করে চার্জশিট দেয়, তাহলে অনেক আসামি বাদ পড়বে। আর আগের মতোই মনগড়া তদন্ত করে সবার বিরুদ্ধে চার্জশিট দিলে বিচার চলাকালে অনেক আসামির দোষ প্রমাণ করা কঠিন হবে। তখন মনগড়া আসামিরা খালাস পেয়ে বাদী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।

ঢালাওভাবে মামলা ও আসামি না করার আহ্বান জানিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও। গত বুধবার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও অভ্যুত্থানের ফলপ্রসূতায় জনমানুষের মনে স্বস্তি এসেছে। এ আন্দোলনের ছাত্র-জনতার আত্মোৎসর্গের প্রতি জাতি কৃতজ্ঞ। অপরপক্ষে যেসব প্রাণহানি হয়েছে সে বিষয়ে ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় রুজু হচ্ছে বহু মামলা। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে অতি সম্প্রতি লক্ষ করা যাচ্ছে, প্রাণহানি ও হতাহতের ঘটনায় ঢালাওভাবে মামলা ও আসামি করে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।’

এতে আরও বলা হয়, ‘অনেক ক্ষেত্রে মামলাগুলোতে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে ও মনগড়া এজাহার দেওয়া হয়েছে বলেও জানা যায়। নানা অসংগতিতে মামলাগুলো গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলছে এবং প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। মামলাগুলোর ফলে একদিকে যেমন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি/পরিবার ন্যায়বিচার বঞ্চিত হওয়ার সম্মুখীন হচ্ছে, অপরদিকে অনেক নিরপরাধ মানুষও হয়রানির শিকার হতে পারে এবং এর ফলে সমাজে অনেকেই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে।’

ঢালাও মামলা দেওয়া হচ্ছে উল্লেখ করে তা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও। গত ২৮ আগস্ট গুলশানে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘যে কোনো মানুষের বিরুদ্ধে শত্রুতা থাকলেই মামলা দেওয়া হচ্ছে। মামলাগুলো নেওয়ার আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যাতে যাচাই করে নেয়, কোনটি সম্ভব, কোনটি সম্ভব নয়। প্রাথমিক যে তদন্ত, সেটা করা দরকার, তা না হলে একটু ব্যক্তিগত শত্রুতা থাকলে তার নাম দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’

ঢালাও আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা নেওয়ার বিষয়ে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, এসব মামলা নিয়ে তারাও অনেকটা বিব্রত। অনেকটা চাপে তারা মামলাগুলো নিতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেক সময়

যাচাই-বাচাই করে মামলা নেওয়ার বিষয়ে জানানো হলেও থানার ভেতরই খারাপ আচরণের শিকার হতে হচ্ছে। তবে এসব মামলা তদন্ত করে নির্দোষ ব্যক্তিদের অবশ্যই বাদ দেওয়া হবে।

ঢালাওভাবে মামলা নিতে পুলিশের ওপর চাপ প্রয়োগের বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তিতেও উঠে এসেছে। গত মঙ্গলবার জারি করা ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘মামলা হওয়া মানেই যত্রতত্র গ্রেপ্তার নয়। এসব মামলার ক্ষেত্রে সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

যমুনা ব্যাংকে চাকরি, বয়স ৪৫ হলেও আবেদন

রাকসু নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শুরু

অবশেষে সুলাইমানিয়ার আকাশপথ খুলে দিল তুরস্ক 

বাস কাউন্টারে আধিপত্য নিয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ, আহত ১৬

দেশে কত দামে স্বর্ণ বিক্রি হচ্ছে আজ

আজ যেমন থাকবে ঢাকার আবহাওয়া

ঐতিহাসিক আল-রাবিয়া মসজিদ আবার খুলে দেওয়া হয়েছে

চাঁপাইনবাবগঞ্জে দুগ্রুপের সংঘর্ষে প্রাণ গেল ২ ভাইয়ের

চবির দুই হল সংসদের ফল পুনর্গণনার ঘোষণা

টিভিতে আজকের খেলা

১০

ঢাকার যেসব এলাকায় আজ মার্কেট বন্ধ 

১১

চট্টগ্রামে ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণে ভবনে আগুন

১২

এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল আজ, জানা যাবে যেভাবে

১৩

১৬ অক্টোবর : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৪

ঢাবির শোক দিবসে জগন্নাথ হল স্মৃতিসৌধে ছাত্রদলের মোমবাতি প্রজ্বালন

১৫

চাকসুতে জয় পেলেন সাদিক কায়েমের ভাই আবু আয়াজ

১৬

চাকসুতে ২৬ পদের ২৪টিতেই শিবিরের জয়

১৭

চাকসুতে ভিপি ও জিএস পদে শিবির, এজিএস পদে ছাত্রদল জয়ী

১৮

স্লোগানে-স্লোগানে ফের উত্তাল চবি

১৯

আরও তিন হলে ভিপি-জিএসে ছাত্রশিবির এগিয়ে

২০
X