বিভিন্ন ধরনের মলম তৈরিতে ব্যবহার হয় নারিকেল তেল। সেই তেল হতে হবে পরিশোধিত, যা আনতে হয় বিদেশ থেকে। তবে উৎপাদন বা আমদানি না করেই দেড় লাখ কেজি তেল সরবরাহ করেছে বলে জানিয়েছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এমনকি কোথা থেকে কিনে সরবরাহ করেছে, তাও বলতে পারে না তারা। এক সরবরাহকারীর আবার কোনো অফিসও নেই। এমন অদ্ভুত জাদুকরী ঘটনা ঘটেছে দেশের একমাত্র সরকারি ওষুধ কারখানা ‘এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডে (ইডিসিএল)’। আর জাদুবলে এমন জাদুর তেল আনার মূল কারিগর ইডিসিএলের প্রাক্তন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ডা. এহসানুল কবির জগলুল।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি মূলত এক ধরনের দুর্নীতি। ডা. এহসানুল কবির জগলুল এ ধরনের অসংখ্য দুর্নীতির হোতা। তিনি টানা ১০ বছর প্রতিষ্ঠানটিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ছিলেন। এ সময়ে নিয়োগ বাণিজ্য, কেনাকাটা, নতুন প্রকল্প গ্রহণ ইত্যাদি করে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। দেশের বাইরে করেছেন বাড়ি-গাড়ি। এসব অভিযোগে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকে ৪৭৭ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাব খাটিয়ে তিনি সব অনিয়মের ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে তিনি লাপাত্তা।
জানা গেছে, বিভিন্ন ধরনের অয়েন্টমেন্ট (মলম) উৎপাদনে পরিশোধিত নারিকেল তেল (আরবিডি কোকোনাট অয়েল) ব্যবহার করা হয়। ২০২৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের কার্যাদেশের বিপরীতে মেসার্স ক্রিস্টাল ট্রেডিং, মেসার্স গোল্ডেন অয়েল মিলস এবং মেসার্স মোনালিসা ইন্টারন্যাশনাল
নারিকেল তেল সরবরাহ করে। এর মধ্যে মেসার্স ক্রিস্টাল ট্রেডিং দুই ধাপে ৪৪ হাজার ৯৮৫ কেজি; মেসার্স গোল্ডেন অয়েল মিলস তিন ধাপে ৯১ হাজার ৭৮০ কেজি এবং মেসার্স মোনালিসা ইন্টারন্যাশনাল ১১ হাজার ৪০০ কেজি তেল সরবরাহ করে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে তিনটি প্রতিষ্ঠান ১ লাখ ৪৮ হাজার ১৬৫ কেজি তেল সরবরাহ করেছে, যা আর্থিক মূল্য প্রায় ১২ কোটি ৫৯ লাখ ৪০ হাজার ২৫০ টাকা (আন্তর্জাতিক অনলাইন মার্কেটের তথ্য)। বিভিন্ন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডকে কার্যাদেশের বিপরীতে আরবিডি কোকোনাট অয়েল (পরিশোধিত নারিকেল তেল) সরবরাহ করে বলে দেখানো হয়; কিন্তু গত ছয় বছর বাণিজ্যিকভাবে দেশে কোনো আরবিডি কোকোনাট অয়েল আমদানি না হওয়ায় সরবরাহকারীরা কীভাবে এই তেল সরবরাহ করল—সেটি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। অর্থাৎ সরবরাহকারীরা এক্ষেত্রে অসত্য ঘোষণায় আরবিডি কোকোনাট অয়েল আমদানি করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। ২০২৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এ ঘটনার সুষ্ঠু অনুসন্ধানে একটি কমিটি গঠন করে।
কাস্টমস কর্তৃপক্ষ যে তিনটি সরবরাহকারী কার্যাদেশে পায়, সেই প্রতিষ্ঠানগুলোয় অনুসন্ধান চালায়। এর মধ্যে মেসার্স ক্রিস্টাল ট্রেডিংয়ের কাছে নারিকেল তেলের উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা জানায়, স্থানীয় বাজার থেকে তেল কিনে সরবরাহ করেছে। তবে সরবরাহকৃত তেল কোথা থেকে বা কার কাছ থেকে বা কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা হয়েছে তার কোনো প্রমাণ তারা দিতে পারেনি। এমনকি এ-সংক্রান্ত যথাযথ উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়। প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী কামরুল হাসান মজুমদার কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে জানান, তার প্রতিষ্ঠান নারিকেল তেল কখনোই আমদানি করেনি। স্থানীয়ভাবে কিনেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করেন। এক্ষেত্রে ক্রয়-বিক্রয় হিসাবের বই দেখাতে পারলেও কোথায় থেকে কিনেছেন তার চালান দেখাতে ব্যর্থ হন।
২০২৪ সালের ১৮ এপ্রিল ক্রিস্টাল ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী কামরুল হাসান মজুমদার লিখিত বক্তব্যে বলেন, স্থানীয় বাজার থেকে নারিকেল তেল সংগ্রহ করে এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানিতে সরবরাহ করেছি। কিন্তু এর কোনো প্রমাণ আমার কাছে নেই। এমনকি ওই প্রতিষ্ঠানের নাম, ঠিকানা উল্লেখ করতে পারব না। সার্টিফিকেট অ্যানালাইসিস রিপোর্ট যেটি আমি এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানিকে সরবরাহ করেছি, তা আমি নিজেই তৈরি করেছি। স্থানীয় বাজার থেকে তেল কিনে মালয়েশিয়ার তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সুন সুন অয়েল মিলস এসডিএন বিএইচডির নাম ব্যবহার করে ফেইক সার্টিফিকেট অব অ্যানালাইসিস তৈরি করে দাখিল করি।
এদিকে আরেক সরবরাহকারী মেসার্স মোনালিসা ইন্টারন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানটি গত তিন বছরে ১১ হাজার ৪০০ কেজি নারিকেল তেল সরবরাহ করে। সরবরাহ করা নারিকেল তেলের অরিজিন মালয়েশিয়া; এমনকি প্রস্তুতকারক হিসেবে মেসার্স প্রিমিয়াম অয়েল অ্যান্ড ফ্যাটস, এসডিএন বিডিএইচ, মালয়েশিয়ার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এর স্বপক্ষে তারা কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি। গত ১১ মার্চ কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এই প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে গিয়ে দেখতে পায়, প্রতিষ্ঠানটি একটি পাঁচতলা আবাসিক ভবনের ঠিকানায় মূসক নিবন্ধন করেছে। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মো. আলমগীর খানের আবাসস্থল। এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানিতে সরবরাহ করা তেল সম্পর্কে তিনি বলেন, এই তেল স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করে সরবরাহ করা হয়েছে। তবে সেই কেনাকাটারও কোনো কাগজপত্র তার কাছে নেই।
তবে অন্য সরবরাহকারী মেসার্স গোল্ডেন অয়েল মিলস জানায়, তারা মালয়েশিয়া থেকে কাঁচামাল আমদানি করে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিশোধ করে সরবরাহ করে থাকে। তারা তাদের বক্তব্যের পক্ষে যাবতীয় দলিল উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়।
কমিটি এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানির গত তিন বছরে যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে আরবিডি নারিকেল তেল সরবরাহ করেছে তাদের নাম, ঠিকানা, বিআইএন ইত্যাদি সংগ্রহ করে। কোম্পানির কার্যাদেশের বিপরীতে সরবরাহকৃত নারিকেল তেলের উৎস (আমদানি, উৎপাদন, সরবরাহ) যাচাই করে। যারা নারিকেল তেল সরবরাহ করেছে তারা এই তেল কীভাবে সংগ্রহ করেছে, তা সংগ্রহ করে। নারিকেল তেল উৎপাদন করে থাকলে কাঁচামাল আমদানি/সংগ্রহের তথ্য যাচাই এবং স্থানীয়ভাবে কিনে সরবরাহ করে থাকলে বিক্রেতার নাম, ঠিকানা ও বিক্রির উৎস বিশ্লেষণ, আমদানির তথ্য যাচাই। আমদানি সংক্রান্ত পণ্যের দলিলাদি ব্যাংক থেকে সংগ্রহ ও পর্যালোচনা, যেসব প্রতিষ্ঠান নারিকেল তেল উৎপাদন করে তার তথ্য পর্যালোচনা, স্থানীয়ভাবে নারিকেল তেল সরবরাহ করে এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানিতে টেন্ডারের মাধ্যমে সরবরাহ করেছে এমন প্রতিষ্ঠানের তথ্য পর্যালোচনা। এ ছাড়া এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানিতে যেসব নারিকেল তেল সরবরাহ করা হয়েছে তার কোয়ালিটি কন্ট্রোল প্রতিবেদন সংগ্রহ, এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানির প্রতিনিধির শুনানি গ্রহণ করে।
ইডিসিএল একটি বিভাগের প্রধান বলেন, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তদন্তের পর ওই তিন প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের কেউ জড়িত ছিল কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলতে পারেন।
ইডিসিএলের অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিষ্ঠানের আগের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এহসানুল কবির জগলুল নিজেই সব কেনাকাটায় যুক্ত থাকতেন। কে কাজ পাবে, কীভাবে কাজ পাবে ইত্যাদি বিষয়ে অন্য কারও মতামতের সুযোগ ছিল না। তিনি ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে দুই বছরের চুক্তিতে এই প্রতিষ্ঠানে যোগদান করে চার দফা মেয়াদ বাড়িয়ে ১০ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি এখান থেকে বিদায় নেন। ইডিসিএলে যোগদানের পর তিনি একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে শত শত কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি করছেন। তার দুর্নীতির বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকে ৪৭৭ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিট হলে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয় দুর্নীতি দমন কমিশনকে। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে তদন্ত রিপোর্ট নিজের অনুকূলে নেন। তিনি প্রতিষ্ঠানে যোগদানের পর প্রায় তিন হাজার লোক নিয়োগ করেন, যার মধ্যে বেশিরভাগই লক্ষ্মীপুর ও গোপালগঞ্জের। এসব নিয়োগে ৫ লাখ থেকে শুরু করে ২০ লাখ পর্যন্ত টাকা লেনদেন হয়েছে।
ইডিসিএলের একাধিক সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা না বাড়িয়ে তিনি কমিশন বাণিজ্যে নেমে পড়েন। ফলে বেশিরভাগ ওষুধ বেসরকারি কোম্পানি থেকে উৎপাদন করতে শুরু করেন।
মূলত মোটা অঙ্কের কমিশনের জন্য প্রাইভেট ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিতে ওষুধ উৎপাদন করেন। এতে প্রতিষ্ঠানের লাভের চেয়ে ব্যক্তির লাভই বেশি হয়, যার ভাগ এমডি থেকে শুরু করে পুরো সিন্ডিকেটের মাঝে বণ্টন করেন। এমনকি যত ধরনের কাঁচামাল কেনা হয়, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সব কেনাকাটার ক্ষেত্রে প্রকৃত দামের চেয়ে বেশি দামে কেনা হয়। ক্রয় কমিটিতে উত্থাপনের আগেই সরবরাহকারীর সঙ্গে দর কষাকষি করা হয় এবং অতিরিক্ত টাকা কীভাবে প্রদান করা হবে, তা চূড়ান্ত হয়। এ ছাড়া তিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকাবস্থায় গোপালগঞ্জে ও মানিকগঞ্জে ইডিসিএলের দুটি পৃথক ইউনিট স্থাপনের কাজ শুরু করেন। এর মধ্যে গোপালগঞ্জের কাজ কয়েক দফা সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে সম্পন্ন হলেও মানিকগঞ্জে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সঙ্গে যোগসাজশে জমি অধিগ্রহণ কেন্দ্র করে শতকোটি টাকা লুটের আয়োজন করেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ডা. এহসানুল কবির জগলুল দুবার লক্ষ্মীপুর-২ আসনের আওয়ামী লীগের মনোনয়ন কেনেন; কিন্তু মনোনয়ন পাননি। তবে ইডিসিএলে যোগদানের পর তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন।
এসব বিষয়ে জানতে এডিসিএলের প্রাক্তন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এহসানুল কবির জগলুলের ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। তিনি বর্তমানে কোথায় আছেন, সেটিও জানা সম্ভব হয়নি।