আঙ্গুর নাহার মন্টি
প্রকাশ : ১১ আগস্ট ২০২৩, ০১:৫৪ এএম
আপডেট : ১১ আগস্ট ২০২৩, ১০:৩৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দুর্নীতি-অর্থ পাচার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা

আলোচনায় নতুন নিষেধাজ্ঞার চাপ
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে যুক্তরাষ্ট্রের তাগিদ নতুন নয়। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বাইডেন প্রশাসন আগের চেয়ে বেশি সক্রিয়। এবার অনেক আগে থেকেই সরকারকে একের পর এক ‘চাপ’ দিয়ে চলেছে। র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা, নতুন ভিসা নীতিসহ প্রকাশ্যে-নেপথ্যে নানা তৎপরতার পাশাপাশি এখন দুর্নীতি ও অর্থ পাচার ইস্যুতে তৎপর হয়েছে প্রভাবশালী দেশটি। ঢাকা ও ওয়াশিংটনের সূত্রগুলো এ তথ্য জানিয়েছে।

সূত্র বলছে, দুর্নীতি ও অর্থ পাচার বিষয়ে এরই মধ্যে একটি তালিকা করেছে বাইডেন প্রশাসন। তবে তাদের দাবি, এটি নির্বাচনকেন্দ্রিক নয়। এমনকি কোনো নির্দিষ্ট দল বা ব্যক্তিকেন্দ্রিকও নয়। এ তালিকায় দুর্নীতিতে জড়িত বাংলাদেশি সব রাজনৈতিক দলের সদস্য, আমলা, ব্যবসায়ী ও প্রশাসনের ব্যক্তিরা রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র আপাতত সেটি নিয়ে কোনো ধরনের ঘোষণা দেবে না। তালিকাভুক্ত ব্যক্তিরা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিতে গেলেই বিষয়টি অনুধাবন করবেন। গত ৬-৮ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বৈশ্বিক দুর্নীতি দমন শাখার সমন্বয়ক রিচার্ড নেফিউ ঢাকা সফরে এ বিষয়ে সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে গেছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্নীতি, আর্থিক অনিয়ম ও অর্থ পাচার বরাবরই বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সুশাসনের ক্ষেত্রে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য অনুসারে, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে গড়ে ৯১ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়। যুক্তরাষ্ট্রও সাম্প্রতিক সময়ে অর্থ পাচার রোধের বিষয়টি বৈশ্বিক ফোকাসে আনার চেষ্টা করছে। মার্কিন আর্থিক সহায়তা পায় এমন দেশগুলোর আর্থিক স্বচ্ছতা নিয়ে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্যুরো অব ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস অ্যাফেয়ার্স নিয়মিত আর্থিক স্বচ্ছতা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গত ২৭ জুন প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনেও আভাস রয়েছে, বাংলাদেশের আর্থিক খাতের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের বিষয়গুলো উন্নয়ন সহযোগী ও দাতা দেশ যুক্তরাষ্ট্রের তীক্ষ্ণ নজরে রয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশসহ ৬৯টি দেশ আর্থিক স্বচ্ছতার ন্যূনতম মানদণ্ড বা শর্ত পূরণ করতে পারেনি। এমনকি এ সময়কালে বাংলাদেশ আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বড় কোনো অগ্রগতিও দেখাতে পারেনি। এতে বাংলাদেশের আর্থিক স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান না মানা ও জবাবদিহির অভাবসহ নানা ত্রুটি তুলে ধরা হয়। এসব বাস্তবতায় রিচার্ড নেফিউ ঢাকা সফরে দুর্নীতি, আর্থিক অস্বচ্ছতা ও অর্থ পাচার ইস্যুটি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করে গেছেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) প্রেসিডেন্ট সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবীর কালবেলাকে বলেন, দুর্নীতি ও অর্থ পাচার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ আগেও ছিল। বাইডেন প্রশাসনের সময়ে এটি বাড়তি গুরুত্ব পাচ্ছে। তারা জি-৭ ও জি-২০-এর মতো ফোরামগুলোতেও এ বিষয়ে সোচ্চার। তাই বাংলাদেশে এ ব্যাপারে তাদের ফোকাসকে শুধু নির্বাচনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যাবে না। এর সঙ্গে উন্নয়ন ও সুশাসন জড়িত। আমি ধারণা করছি, দেশটি ইতোমধ্যে বাংলাদেশকে দুর্নীতি ও অর্থ পাচার ইস্যুতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে। এখন সরকার ও সংশ্লিষ্টরা এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিলে সেখানে কোনো ধরনের চাপের প্রশ্ন আসবে না। যদি ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো কোনো অ্যাকশনে যাবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, নির্বাচন কেন্দ্র করে নতুন ভিসা নীতিসহ মার্কিন কড়া বার্তার পর গত কয়েক মাসে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অনেক বাংলাদেশি দেশটি থেকে অর্থ সরিয়ে নিচ্ছে। এদিকে সুইস ব্যাংক থেকেও বিপুল অঙ্কের অর্থ সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বাইডেন প্রশাসনের নজরে এসেছে, এ অর্থের কিছুটা বাংলাদেশে এলেও বেশিরভাগই মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় চলে যাচ্ছে। অতীতের রেকর্ড অনুসারে, নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে অর্থ পাচারের ঘটনা বেড়ে যায়। তাই এ বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে কাজও করতে চায় দেশটি। নেফিউ সফরে সে বার্তাও দিয়ে গেছেন।

নেফিউর সঙ্গে বৈঠকের পর পররাষ্ট্র সচিব (সিনিয়র সচিব) মাসুদ বিন মোমেন জানান, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। নিষেধাজ্ঞাকে তারা দুর্নীতি দমনের হাতিয়ার (টুল) মনে করে। তাই ভবিষ্যতের বড় প্রকল্পে অর্থায়নের ক্ষেত্রে দুর্নীতি বিবেচনায় নিতে পারে। এ ছাড়া আলোচনায় আর্থিক অনিয়ম ও অর্থ পাচার প্রতিরোধে এ দেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর দক্ষতা বৃদ্ধির ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ব্যাপারে সহযোগিতার বিষয়েও আলোচনা হয়েছে।

গত বুধবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার স্পষ্টই দুর্নীতি দমনে নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি পাচারকৃত সম্পদ জব্দের কথাও বলেন। তিনি বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটি হাতিয়ার হতে পারে। তবে আমাদের কাছে অন্যান্য উপায়ও রয়েছে। যেমন, পাচারকৃত সম্পদ জব্দ করা এবং আমাদের বন্ধু দেশগুলোতে তথ্য সরবরাহ করা, যাতে সংশ্লিষ্ট পাচারের বিষয়ে তারা মামলা করতে পারে। যারা দুর্নীতিবাজ এবং তাদের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের নিরপেক্ষভাবে নির্মূল করতে আমরা বাংলাদেশকে উৎসাহ দিই।’

এ প্রসঙ্গে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার কালবেলাকে বলেন, দুর্নীতি ও অর্থ পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সরঞ্জাম রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে, আইন প্রয়োগকারী কর্মীদের প্রশিক্ষণ, সম্পদ জব্দ করা, অপরাধের বিচার করা এবং সরকারের সঙ্গে তথ্য বিনিময়। এর মাধ্যমে অপরাধের বিচারের পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা যাবে। তবে নীতিগতভাবে যুক্তরাষ্ট্র সময়ের আগে দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা করে না।

এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ব্যবসা সম্প্রসারণে আগ্রহী উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেখতে চায়। আগামী নির্বাচন যেন আন্তর্জাতিক মানের হয়, যেখানে বাংলাদেশের মানুষ তাদের নেতা নির্বাচন করতে পারে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গতকাল বৃহস্পতিবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বিশিষ্টজনের সঙ্গে মতবিনিময়ের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। পাচারকৃত সম্পদ জব্দ নিয়ে মার্কিন অবস্থান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে যারা দুর্নীতি করে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ পাচার করে, তাদের টাকা জব্দ করলে বাংলাদেশ সরকার খুশি হবে। কারণ, ওই দেশে একটি আইন আছে, আপনি টাকা নিয়ে গেলে সেখানে ওয়ার্ক পারমিট পাবেন, নাগরিকত্ব পাবেন। এটি শুধু ওদের দেশে নয়, বিভিন্ন দেশে আছে।

এদিকে ওয়াশিংটন ঘনিষ্ঠ একাধিক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সূত্র বলছে, নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও রাজনীতিকদের নজরে রাখার পাশাপাশি বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতিও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন নতুন ভিসা নীতিসহ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা নানা চাপেও নির্বাচন ইস্যুতে দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দলের অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি। তাই নতুন করে সরকারকে চাপে ফেলতে দুর্নীতি ও অর্থ পাচার ইস্যুতে তৎপরতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। সরকারকে এ বার্তা দিতেই প্রথমবারের মতো দুর্নীতি দমনবিষয়ক কোনো মার্কিন প্রতিনিধিকে ঢাকা সফরে পাঠিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। যদিও নেফিউ ঢাকায় বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, নিষেধাজ্ঞাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে না তার দেশ।

জানা গেছে, বড় প্রকল্পে আর্থিক অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রতিরোধে ‘ব্লু ডট নেটওয়ার্কে’ বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। রিচার্ড নেফিউর ঢাকা সফরে এ নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব দিয়ে গেছেন। এ ছাড়া আগামী ১১-১৫ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টায় অনুষ্ঠেয় ২০তম দুর্নীতিবিরোধী সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানিয়ে গেছেন তিনি। বাংলাদেশ এ সম্মেলনে অংশ নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আকিজ বশির গ্রুপে চাকরি, বেতন ছাড়া পাবেন আরও বিভিন্ন সুবিধা

দুই কোরিয়ার সীমান্তে উত্তেজনা তুঙ্গে

৪ মাস পর বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে চাল আমদানি শুরু

২০২৬ সালের এইচএসসি পরীক্ষার সময় জানাল এনসিটিবি

রিমান্ডের পর হাসপাতালে ভর্তি সাবেক প্রেসিডেন্ট

জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে : ইলিয়াসপত্নী লুনা

ছাত্রদের রাজনীতিতে ব্যবহার করা জুলুম : বায়তুল মোকাররমের খতিব

ডেঙ্গুতে আরও ৪ জনের মৃত্যু

অ্যাডিলেডে শেষ ম্যাচেও সোহানদের ভরাডুবি

লটারির টিকিট কেটেই নারী দেখলেন ২ কোটি টাকা তার হাতে

১০

কোটালীপাড়া পৌর ছাত্রলীগ নেতা জামিল গ্রেপ্তার

১১

দেশে বিশ্বমানের লিফট তৈরি করছে প্রাণ-আরএফএল

১২

পরিবর্তন হয়নি যেসব ফোনের ডায়াল প্যাড, কারণ কী?

১৩

‘ব্যাটিংয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ ও নেপাল একই মানের দল’

১৪

হত্যা মামলায় জাবির সাবেক শিক্ষক গ্রেপ্তার

১৫

ঘরের যে ৮টি জিনিস সরিয়ে রাখলেই ওয়াই-ফাইয়ের গতি বাড়বে

১৬

রিমান্ড শেষে মাই টিভির চেয়ারম্যান নাসির কারাগারে 

১৭

সরকারের একার পক্ষে স্বাস্থ্যখাতের সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব না : স্বাস্থ্য উপদেষ্টা

১৮

আশাশুনিকে সাতক্ষীরা-৩ আসনে ফেরানোর দাবি

১৯

‘খালেদা জিয়া পেছনের দরজা নয়, সম্মুখে রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন’

২০
X