বেসরকারি খাতের ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের দুই গ্রাহককে অবৈধ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলীর সুনজরে থাকা মুলতাজিম গ্রুপকে একক গ্রাহক ঋণসীমা অতিক্রম করে ৯৪৮ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী ৩৭৬ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ পাওয়ার কথা নয়। শুধু তাই নয়, একই গ্রাহকের দুই গ্রুপকে ৮৬ কোটি টাকার মুনাফা (সুদ) মওকুফের সুবিধা দিয়েছেন তিনি। এস আলমের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এসব প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে একাধিকবার পুনঃতপশিল সুবিধাও। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
তথ্য বলছে, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মতিঝিল ও দিলকুশা শাখার গ্রাহক মুলতাজিম গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো। আইন অনুযায়ী, একক কোনো গ্রাহককে যেকোনো ব্যাংক মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দিতে পারে। অথচ মুলতাজিম গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই নীতিমালা লঙ্ঘন করে ঋণ দিয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক।
শুধু তাই নয়, মুলতাজিম গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকে একাধিকবার পুনঃতপশিল সুবিধাও দিয়েছে ব্যাংকটি। একই সঙ্গে দুই সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মোট ৮৬ কোটি টাকার মুনাফা মওকুফ করেছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ২০৮তম বোর্ড সভায় মুলতাজিম গ্রুপভুক্ত জে এস ট্রেডিংকে ২০ কোটি টাকার মুনাফা মওকুফ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে এস আলম স্বার্থ সংশ্লিষ্ট একাধিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেনের তথ্যও পেয়েছেন পরিদর্শকরা। শুধু জেএস ট্রেডিং নয়, একই মাসে মুলতাজিম গ্রুপের গ্রুপভুক্ত শাহাজাদি ট্রেডার্সের ৬৫ কোটি টাকা মুনাফা মওকুফ করে প্রতিষ্ঠানটি।
এদিকে, মুলতাজিম গ্রুপের ৬টি প্রতিষ্ঠানের ঋণ ফের পুনঃতপশিলের প্রক্রিয়া চলছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে, এসএমএম টেক্সটাইল মিলস, এ এস এফ ফেব্রিক্স মিলস, মাতাম মাল্টি ফাইবার মিলস, মুলতাজিম স্পিনিং মিলস, মাতাম ফাইবার মিলস ও মাতাম স্পিনিং মিলস লিমিটেড। এ ছাড়া জে এস ট্রেডিং ও শাহাজাদি ট্রেডার্সের ঋণ এরই মধ্যে অনুমোদন করা হয়েছে।
অন্যদিকে, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মতিঝিল শাখার গ্রাহক মেসার্স টাইমস সিকিউরিটিস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটিকে ঋণ বিতরণের সময় মতিঝিল শাখার ম্যানেজার ছিলেন বর্তমান এমডি সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলী। চট্টগ্রামভিত্তিক বিতর্কিত এস আলম গ্রুপের সাইফুল আলম মাসুদের দুই ভাবি (ফারজানা বেগম, মারজিনা শারমীন) ও এক সম্বন্ধী (মো. আরশেদ) মিলে এ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন। ২০১১ সালের জুলাই মাসে প্রতিষ্ঠানটিকে ১ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হলেও মাত্র ৫ মাসের ব্যবধানে এই ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৪০ কোটি টাকায়। ওই সময় প্রতিষ্ঠানটির থেকে নেওয়া হয়নি কোন করপোরেট গ্যারান্টি। এমনকি সিকিউরিটি হিসাবে নেওয়া ৩৫ চেক নিয়েও রয়েছে পরিদর্শকের প্রশ্ন।
তথ্য বলছে, এই ঋণের পরিদর্শনে ঋণের বিষয়ে পর্যাপ্ত কাগজপত্রও পায়নি পরিদর্শক দল। এক্ষেত্রে পরিদর্শকরা বলছেন, পূর্বের চেয়ারম্যানের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান হওয়ায় পর্যাপ্ত কাগজপত্র সংরক্ষণ করা হয়নি। গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণটির ৭ কিস্তির সাড়ে ৯ কোটি টাকা মন্দ মানে খেলাপি হয়ে আছে। এস আলম সংশ্লিষ্ট এ প্রতিষ্ঠানের ঋণ আদায়ে এখনো কোনো মামলা করেনি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। বর্তমানে ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৮২ কোটি টাকা। পুনঃতপশিল করার সময় প্রতিষ্ঠানটির ঋণে ৩৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকার মুনাফা মওকুফ করা হয়। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
তথ্য বলছে, মেসার্স টাইলস সিকিউরিটিস লিমিটেডকে খেলাপি হওয়ার পরও ২০২০ সালের জুলাই মাসে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ২২৩তম বোর্ডে নতুন করে ৬৪৯ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করে। কিন্তু করোনাকালীন হওয়ায় এই ঋণে আপত্তি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ঋণটি পরে আর বিতরণ করা সম্ভব হয়নি। অনুমোদনের সময় ঋণটি ১ বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরের জন্য অর্থাৎ ২০৩০ সালের জুলাই পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়।
টাইলস সিকিউরিটিসের বিষয়ে জানতে চাইলে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মতিঝিল শাখা ম্যানেজার আমিনুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ঋণটি বর্তমানে খেলাপি। আমরা তাদের সঙ্গে বসেছিলাম। তারা ৭ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। আর বাকি টাকা আদায়ে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তুতি চলছে। তবে মুলতাজিম গ্রুপ আমার গ্রাহক নয়। তারা সম্ভবত দিলকুশা শাখার গ্রাহক।
মুলতাজিম গ্রুপ সম্পর্কে জানতে চাইলে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের দিলকুশা শাখা ম্যানেজার তহুরুল হক কালবেলাকে বলেন, ঋণটি বর্তমানে খেলাপি অবস্থায় আছে। তবে পুনঃতপশিলের জন্য প্রধান শাখায় প্রক্রিয়াধীন আছে। মুলতাজিম গ্রুপ অনেক বড় গ্রাহক। তাদের ব্যবসাও চলমান। আমরা আশাবাদী তাদের থেকে অর্থ উত্তোলন করা সম্ভব। বর্তমানে আমার শাখায় তার ঋণ ৬০০ কোটি টাকার বেশি। গ্রাহক আমাদের মৌখিকভাবে জানিয়েছেন পুনঃতপশিলের পর ছয় মাসের মধ্যে পুরো টাকা পরিশোধ করে দেবেন।
সার্বিক অনিয়মের বিষয়ে জানতে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান গত রোববার কালবেলাকে বলেছেন, তাদের ব্যাংকে নতুন করে অডিট শুরু হয়েছে। এ কারণে এমডিকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। অডিটে অযাচিত হস্তক্ষেপ ঠেকাতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এটাই আন্তর্জাতিক প্র্যাকটিস।
এমডি ও কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ঋণ অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা কালবেলাকে বলেন, আপনি যে ব্যাংকের কথা বললেন সেই ব্যাংকে এরই মধ্যে অডিটর নিয়োগ করা হয়েছে। তারা দায়দায়িত্ব নিরূপণ করবেন। এরপর কারও বিরুদ্ধে কোনো অনিয়ম পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকও পরিদর্শনে কোনো অনিয়ম পেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।