আলী ইব্রাহিম
প্রকাশ : ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:২৫ এএম
আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:২৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মাঠে ৫০ হাজার কোটি অনাদায়ি রেখে টাকা খুঁজছে এনবিআর

নতুন ভ্যাট আরোপ
মাঠে ৫০ হাজার কোটি অনাদায়ি রেখে টাকা খুঁজছে এনবিআর

নিত্যপণ্যের বাজারে এমনিতেই হিমশিম অবস্থা সাধারণ মানুষের। নতুন করে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে সম্পূরক মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট)। অথচ ভ্যাট সংক্রান্ত মামলা ও বকেয়া মিলে মাঠে আটকে আছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার ভ্যাট-সংক্রান্ত মামলায় আটকে আছে ৩১ হাজার কোটি টাকা। সরকারি প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলার কাছেই বকেয়া পড়ে আছে ২০ হাজার কোটি টাকা। বড় বড় অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাছেও ভ্যাটের টাকা আটকে আছে। মাঠের এই টাকা আদায়ে গতি না বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে কষ্টে ফেলে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা আদায়ে নতুন ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিআর। এটাকে রাজস্ব আহরণের ‘সহজ পথ’ বলে মনে করলেও বছরের মাঝপথে ভ্যাট বাড়ানোকে অযৌক্তিক বলেছেন অর্থনীতিবিদরা।

গত বৃহস্পতিবার রাতে মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ এবং দ্য এক্সাইজ অ্যান্ড সল্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ নামে এ দুটি অধ্যাদেশ জারি করে এনবিআর। তার আগে ১ জানুয়ারি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক বাড়াতে এনবিআরের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। অধ্যাদেশ জারির পরপরই এনবিআরের এ বিষয়ে নির্দেশনা সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হয়ে গেছে। নানা মহল থেকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে বর্তমান সরকার। শতাধিক পণ্যের ওপর ভ্যাট আরোপকে সরকারের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও। তারা দ্রুত সরকারকে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। ব্যবসায়ী মহল থেকেও প্রতিবাদ এসেছে। তারা বলছেন, ‘আত্মঘাতী’ এই পদক্ষেপ জনগণের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। কারণ, এই খরচ পুরোটাই জনগণের ঘাড়ে গিয়ে পড়বে। এর ফলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ এবং ব্যবসা বাধাগ্রস্ত হবে বলেও মত ব্যবসায়ীদের।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে ভ্যাট সংক্রান্ত ৩ হাজার ৫৪৯টি মামলা চলমান রয়েছে। এই মামলায় আটকে আছে এনবিআরের ৩১ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগে চলমান রয়েছে ৩ হাজার ৩৯১টি মামলা। আর হাইকোর্টের এসব মামলায় জড়িত ভ্যাটের পরিমাণ ২৮ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া আপিল বিভাগের ১৫৮ মামলায় আটকে আছে এনবিআরের ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা।

সারা দেশে ভ্যাটের সিংহভাগ আদায় করে এনবিআরের আওতাধীন বৃহৎ করদাতা ইউনিট, এলটিইউ (ভ্যাট)। সারা দেশের বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এই কমিশনারেটে ভ্যাট দিয়ে থাকে। যেসব প্রতিষ্ঠান ১০ কোটি টাকার বেশি দেয়, সেসব প্রতিষ্ঠান এলটিইউ ভ্যাটের তালিকাভুক্ত। বর্তমানে এলটিইউ ভ্যাটে ১০৯টি প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে মামলা-সংক্রান্ত জটিলতায় আটকে আছে প্রায় ১২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এগুলোর মধ্যে টোব্যাকো কোম্পানিতে আড়াই হাজার কোটি টাকা। মোবাইল অপারেটর কোম্পানিতে ১ হাজার ৭৫ কোটি টাকা। ফার্মাসিটিউক্যালসে ১৪০ কোটি টাকা এবং সিমেন্ট কোম্পানিতে ১০ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে এনবিআরের ভ্যাট বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য ড. আব্দুর রউফ কালবেলাকে বলেন, আমরা বর্তমান অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে যেসব কৌশল নিয়েছি, তার মধ্যে অন্যতম হলো বকেয়া আদায়। যেসব বকেয়া নিরঙ্কুশ, অর্থাৎ আইনের সব কার্যক্রম শেষ করে যেসব বকেয়ার সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো আদায় করার জন্য প্রতিটা কমিশনারেটে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বকেয়া আদায় করার জন্য ভ্যাট আইনে যেসব পদক্ষেপ রয়েছে, সেগুলো প্রয়োগ করা হচ্ছে। তবে, এমন কিছু প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া রয়েছে, বর্তমানে যার কোনো অস্তিত্বই নেই। সেসব ক্ষেত্রে বকেয়া আদায় করার কার্যক্রম গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

পেট্রোবাংলার বকেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া রয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে আইনের কঠোর প্রয়োগ সম্ভব হচ্ছে না। তবে, অর্থবছরের শেষ নাগাদ আমরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বকেয়া আদায় করতে পারব বলে আশা করি।

হুট করে ভ্যাট বাড়ানোর বিষয় নিয়ে অবাক অর্থনীতিবিদরাও। জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান কালবেলাকে বলেন, এনবিআর হুট করে ভ্যাট আরোপ করার আগে বিকল্প চিন্তা করতে পারত। বিশেষ করে এনবিআরের বকেয়া পাওনা আদায়ে জোর দেওয়া যেত। মামলা-সংক্রান্ত জটিলতায় আটকে থাকা ভ্যাট আদায়েও জোর পদক্ষেপ নিতে পারত। এক্ষেত্রে অংশীজনের (স্টেক হোল্ডার) সঙ্গে কথা বলে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিতে পারত। তাহলে দেশের এই বিরূপ প্রতিক্রিয়া রোধ করা যেত।

সূত্র আরও জানায়, এনবিআরের সবচেয়ে বেশি ভ্যাটের বকেয়া রয়েছে সরকারি সংস্থা পেট্রোবাংলার কাছে। এর পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকা। দীর্ঘদিন ধরে চিঠি চালাচালির পর বকেয়া আদায়ে একটি সিদ্ধান্তে এসেছিল এনবিআর। এক্ষেত্রে প্রতি বছর পেট্রোবাংলা ৫ হাজার কোটি টাকা করে এনবিআরকে পরিশোধ করবে। সেই হিসাবে গত অর্থবছরও ৫ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছে পেট্রোবাংলা। তবু প্রতিষ্ঠানটির কাছে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ বকেয়া ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত বকেয়ার পরিমাণ ১৩ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা। ভ্যাটের বাইরে আয়কর ও আমদানি শুল্ক বাবদ পাওনা রয়েছে আরও ১৪ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা। আর এলএনজি আমদানির শুল্ক হিসেবে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস পেট্রোবাংলার কাছে পাবে ১৪ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা।

অন্যদিকে ভ্যাট আদায় এবং নতুন করে রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটনে এনবিআরে গতি নেই বললেই চলে। রাজস্ব ফাঁকি উদঘাটনে এনবিআরের অডিট ও প্রিভেন্টিভ প্রায় বন্ধ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি এ বিষয়ে চিঠি দিয়ে নতুন করে অডিট বন্ধ করে দিয়েছে। এ ছাড়া ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটনে প্রিভেন্টিভের গতি কমায় ভ্যাট আদায়ের গতিও তলানিতে ঠেকেছে। এরই মধ্যে রাজস্ব ঘাটতি প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকায় ঠেকেছে। এতে ‘শর্টকাট’ রাজস্ব আহরণ বাড়াতে নতুন করে উচ্চমূল্যের পণ্যে আরও ভ্যাটের হার বাড়িয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে নিত্যপণ্যের বাইরে ভ্যাট আরোপের কথা বলা হলেও আদতে রান্নার গ্যাস থেকে শুরু করে জীবনরক্ষাকারী ওষুধেও ভ্যাট আরোপ করেছে এনবিআর। এ ছাড়া শুল্ক আরোপের মাধ্যমে কথা বলার খরচও বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার। চলতি অর্থবছরে প্রথম দফায় বাড়ানোর পর গত বৃহস্পতিবার আবারও কর বাড়ানোটা সাধারণ মানুষের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে। রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে আবাসিক হোটেলেও ভ্যাটের হার বাড়িয়েছে এনবিআর। তামাকজাত পণ্যেও অর্থবছরে দ্বিতীয়বারের মতো কর বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া বার্ষিক টার্নওভারের সীমা কমিয়ে দেওয়ায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যবসাও লাটে উঠবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, এনবিআর ভ্যাট আদায়ের কঠিন পথে না গিয়ে সহজ পথে হাঁটছে। পরোক্ষ কর, অর্থাৎ ভ্যাট আরোপ করা তাদের এমনি একটি পদক্ষেপ। ভ্যাটের বকেয়া কিংবা রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটনের দিকে মনোযোগ দিলে ভ্যাট আদায় যদিও বাড়ত, তবে বিষয়টি কঠিন। তাই দ্রুত রাজস্ব আহরণ করতে এনবিআর নতুন করে ভ্যাটের হার বাড়িয়েছে। এতে দেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তবে শুল্ক ও কর বাড়ানোর জন্য এই সময়টাকে যথোপযুক্ত মনে করছেন না এই অর্থনীতিবিদ।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শীত জেঁকে বসেছে তেঁতুলিয়ায়, তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রির ঘরে

ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিমকে নিয়ে অপপ্রচার

বিশ্বকাপের সুপার এইটে উঠলে টাইগারদের সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ যারা

দেশে কত দামে স্বর্ণ বিক্রি হচ্ছে আজ

ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ৬ ভবন ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা

রাজধানীতে আজ কোথায় কী

একটানা পাঁচ ম্যাচ খেলবে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, সূচি প্রকাশ

সংকটে দীপিকার স্কিন কেয়ার ব্র্যান্ড

কন্যাসন্তানের বাবা হলেন নিলয়

১৯ দেশের গ্রিন কার্ডধারীদের পুনর্মূল্যায়ন করবে যুক্তরাষ্ট্র, তালিকায় যারা

১০

সৃজিতের সিনেমায় বদলে গেল নায়িকা

১১

খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনা করে ফুল পাঠিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী

১২

হংকংয়ের আগুন নিয়ন্ত্রণে, নিহত অন্তত ৯৪

১৩

শুষ্ক আবহাওয়ায় ঢাকায় তাপমাত্রা নেমে ১৮ ডিগ্রিতে

১৪

ভূমিকম্পের ‘উচ্চ ঝুঁকিতে’ মধুপুর ফল্ট, শঙ্কিত টাঙ্গাইলবাসী

১৫

২৮ নভেম্বর : ইতিহাসের এই দিনে যা ঘটেছিল

১৬

ওয়াশিংটনে গুলিবর্ষণ, নিহত ন্যাশনাল গার্ড সদস্য

১৭

আজ টানা ৯ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকবে না যেসব এলাকায়

১৮

পাকিস্তানিদের ভিসা দিচ্ছে না আমিরাত, কিন্তু কেন?

১৯

বিএনপি প্রার্থীর বহরে থাকা গাড়িতে আগুন, দগ্ধ ৪

২০
X