আমেনা হীরা
প্রকাশ : ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৫০ এএম
আপডেট : ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৫১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ঢাকার সঙ্গে সুসম্পর্ককে কেন গুরুত্ব দিচ্ছে বেইজিং

কূটনীতি
ঢাকার সঙ্গে সুসম্পর্ককে কেন গুরুত্ব দিচ্ছে বেইজিং

এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। জুলাই বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার আমলেই মূলত বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্যিক সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছায়। সেই সরকারের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত সুসম্পর্ক বজায় ছিল চীনের। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারকেও শুরু থেকেই সমর্থন দিয়ে আসছে চীন। অর্থাৎ বাংলাদেশের সঙ্গে বিদ্যমান সুসম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারেই আগ্রহী বেইজিং।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে চীন একদিকে যেমন অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দিয়ে আসছে, তেমনি বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগও বাড়িয়েছে। এর অংশ হিসেবে চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে সম্প্রতি দেশটি সফর করে এসেছেন বিএনপি, জামায়াতসহ অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। এর ধারাবাহিকতায় এবার চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আমন্ত্রণে ২০ জানুয়ারি পাঁচ দিনের সফরে বেইজিং যাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। তার এ সফর নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। বৈঠকে বাংলাদেশ-চীন দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা বাড়ানোর পাশাপাশি যৌথভাবে বাংলাদেশ-চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপন নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত বাংলাদেশে চীনের বিশাল বাজার ও বিভিন্ন সেক্টরে বিপুল বিনিয়োগ, আঞ্চলিক নিরাপত্তাসহ কৌশলগত কারণেই ঢাকার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চায় বেইজিং। তাদের মতে, ভূরাজনৈতিক কারণে চীনের জন্য বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চীনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত জায়গা। পাশাপাশি প্রায় ১৮ কোটি জনসংখ্যার এই দেশ চীনা রপ্তানিমুখী অর্থনীতির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ বাজার।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ চীনে ৬৭৭ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে এবং চীন থেকে ২২.৯০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে।

চীন বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগীও। বিশেষ করে পদ্মা সেতুসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে চীন আর্থিক ও প্রকৌশলগত সহযোগিতা দিয়ে আসছে বাংলাদেশকে। পাশাপাশি বিদ্যুৎকেন্দ্র, সড়ক, সেতুসহ বাংলাদেশের বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পে বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ রয়েছে চীনের।

এ ছাড়া সামরিক দিক থেকেও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের দশকের পর দশক ধরে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সমরাস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জামের বেশিরভাগই আসে চীন থেকে। প্রতিরক্ষা খাতবিষয়ক আন্তর্জাতিক থিঙ্কট্যাঙ্ক সুইডেনের স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশের আমদানি করা সমরাস্ত্রের ৭২ শতাংশই সরবরাহ করে চীন। শুধু সেনাবাহিনীই নয়, বাংলাদেশের নৌবাহিনীর বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বেইজিং। যার উদাহরণ চট্টগ্রামে নির্মিত বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র সাবমেরিন ঘাঁটি ‘বিএনএস শেখ হাসিনা’, যেখানে ছয়টি সাবমেরিনের পাশাপাশি আটটি যুদ্ধজাহাজ অবস্থান করতে পারে। এ ছাড়া বাংলাদেশের সামরিক ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যুক্ত হওয়া দুটি সাবমেরিনের সরবরাহকারীও চীন।

সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সফিউল্লাহ মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনীতি পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, চীন মূলত তা পর্যবেক্ষণ করছে। সরকার পরিবর্তনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক কোনো বিষয়ে অথবা কূটনৈতিক কোনো বিষয়ে মন্তব্য করছে না, তারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।

তিনি বলেন, ‘বিগত দিনগুলোতে দেখা গেছে, তাদের বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় যে দলগুলো রয়েছে; বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে তারা সমানভাবেই সম্পর্ক রেখেছে। তারা রাজনৈতিকভাবে কোনো একটা দলের পক্ষে থাকে না। তারা যে সরকার আছে তাদের সঙ্গেই কাজ করে। তবে ইদানীংকালে বাস্তবতার নিরিখে তারা জামায়াতের সঙ্গেও সম্পর্ক রাখতে চায় এবং তাদের (জামায়াত) আদর্শ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বোঝার জন্য দলটির সঙ্গে তারা যোগাযোগ রক্ষা করার চেষ্টা করছে। যে কারণে জামায়াতের একটি ডেলিগেশনকে তাদের দেশে সফরে নিয়েছে। আর বিএনপির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বহু বছর থেকে, যখন জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তখন থেকে বিএনপি ও চীনের সম্পর্কের সূচনা হয়। বাংলাদেশের চীনের যে বিনিয়োগ এবং তাদের যে সম্পর্ক সেটি মূলত শুরু হয় জিয়াউর রহমানের সময় থেকেই। এমনকি বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সঙ্গে চীনের যে সম্পর্ক, সেটিও জিয়াউর রহমানের সময় হয়েছে। তখন থেকেই বাংলাদেশ তাদের সামরিক বাহিনীর জন্য চীন থেকে অস্ত্র কেনাকাটা শুরু করে। সামরিক বাহিনীর প্রায় ৭৫ শতাংশ লজিস্টিক সাপোর্ট চীন থেকে আমদানি করা হয়।’

তবে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চীন বাংলাদেশে সেভাবে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখছে না বলে মনে করেন সাবেক এ কূটনীতিক। তিনি বলেন, ‘চীন বাংলাদেশের এ বর্তমান সময়ে সামনে এসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে না, কারণ ভারত এটাকে ভালোভাবে নেবে না। যে কারণে তারা সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করছে এবং ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থা কোন দিকে যাচ্ছে, সে বিষয়গুলো তারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। বাংলাদেশে যেমন অর্থনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এবং ভূরাজনৈতিকভাবেও বাংলাদেশের গুরুত্ব অপরিসীম, সে কারণে সরকার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চীন একটি সুসম্পর্ক রাখার চেষ্টা করছে এবং পরিস্থিতি তারা নজরে রাখছে।’

এম সফিউল্লাহ মনে করেন, বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চীনা বিনিয়োগ অক্ষুণ্ন রাখা আর নতুন নতুন ক্ষেত্রে চীনের অংশীদারত্ব বাড়াতেই আগ্রহী বেইজিং। তার মতে, বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের এতদিন যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বজায় ছিল, তা ধরে রাখতে চাইছে দেশটি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের বিনিয়োগগুলোতে যাতে হুমকিতে না পড়ে সে বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই বর্তমান সরকারের সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলছে চীন।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টার আসন্ন চীন সফরে দুই দেশের সম্পর্ক ঘিরে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হতে পারে বলেও মনে করেন এম সফিউল্লাহ।

এদিকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে বেইজিং নতুন নতুন ক্ষেত্রে ঢাকার সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াতে আগ্রহী বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওবায়দুল হক।

তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে তো একটা রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়েছে। তাই চীনের জন্য একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে, তারা এ সুযোগটা নিতে চায়। বাংলাদেশের সঙ্গে আরও কোথায় কোথায় এনগেজমেন্ট বাড়ানো যায়, সেগুলোর সন্ধান করছে তারা। যেসব জায়গায় ধরুন অ্যাপ্লিকেশনস আছে, সেসব জায়গায় চীন যুক্ত হতে চাচ্ছে। তাদেরও বাংলাদেশকে নিয়ে একটা ভূরাজনৈতিক স্বার্থ আছে আমরা জানি, তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ অবস্থাটা কাজে লাগাচ্ছে তারা।’

তবে পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন দলের সঙ্গে বেইজিংয়ের যোগাযোগ বাড়ানোর বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দিতে চান না এ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ। ওবায়দুল হক বলেন, ‘চীনে সবকিছু সামলায় চায়না কমিউনিস্ট পার্টি। রাজনৈতিক দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো চীনের নিয়মিত প্রসেস। প্রতি বছরই রাজনৈতিক দলগুলোর বড় বড় ডেলিগেশন যায়। আওয়ামী লীগ আমলেও অনেক ডেলিগেশন ভিজিট করেছে, যা হয়তো গণমাধ্যমে আসেনি, কিন্তু এর আগেও এমন সফর অনেক হয়েছে। এটা আসলে তাদের স্টাইল, তারা এভাবে পলিটিক্যাল পার্টির সঙ্গে এনগেজমেন্ট করে। তাই এ সফরগুলোকে বাড়তি গুরুত্ব দিতে আমি নারাজ।’

পররাষ্ট্র উপদেষ্টার আসন্ন চীন সফর ইতিবাচকভাবেই দেখছেন অধ্যাপক ওবায়দুল হক। তিনি বলেন, ‘দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে এসব ভিজিট হয়েই থাকে। এতে দুই দেশের বাণিজ্যসহ নানা দিক নিয়ে আলোচনায় বসারও একটা সুযোগ হচ্ছে তাদের। তাই উপদেষ্টাকে ডাকায় আমাদের জন্য ইতিবাচক।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

অস্ট্রেলিয়ায় জলবায়ু ভিসায় গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ

দেশে আজ থেকে স্বর্ণ বিক্রি হবে নতুন দামে

জি৭ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের যুগান্তকারী চুক্তি

জামায়াতের প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাইলেন আ.লীগ নেতা

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে যে বার্তা দিল আবহাওয়া অফিস

মালয়েশিয়ায় ৫ গাড়ির ভয়াবহ সংঘর্ষ

মুরাদনগরে নারীকে নির্যাতনের ঘটনায় আসিফ মাহমুদের স্ট্যাটাস 

নারীকে ন্যাড়া ও বিবস্ত্র করে খাটের সঙ্গে বেঁধে মারধর

কুমিল্লায় ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি ফজর আলী গ্রেপ্তার

আজ পরীক্ষায় বসবেন সেই আনিসা

১০

দুপুরের মধ্যে যেসব জেলায় হতে পারে ঝড় 

১১

কুমিল্লায় নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ, ভিডিও ভাইরাল করা তিনজন গ্রেপ্তার

১২

২৯ জুন : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৩

রোববার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১৪

২৯ জুন : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৫

অপারেশন সিঁদুরে নেতৃত্ব দেওয়া সেই পরাগ হলেন ‘র’ প্রধান

১৬

ছায়া সংসদে বিতর্কে চ্যাম্পিয়ন ইডেন মহিলা কলেজ

১৭

বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে মামলা নেওয়ায় থানা ঘেরাওয়ের অভিযোগ

১৮

নানা সমস্যায় জর্জরিত বাঙলা কলেজের আবুল কাসেম ছাত্রাবাস

১৯

পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের সুরক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই : মেঘনা গুহঠাকুরতা

২০
X