ইউরোপের অস্তিত্ববাদী দর্শনের জনক বলা হয় যাকে, সেই ডেনিশ দার্শনিক সোরেন কিয়েরকেগার্ড বিবাহ নিয়ে তার চমৎকার মতামত তুলে ধরেছিলেন। তার আইদার/অর বইতে লিখেছেন, ‘যদি তুমি বিয়ে করো, তাহলে তুমি অনুশোচনা করবে; যদি তুমি বিয়ে না করো, তাহলেও তুমি অনুশোচনা করবে; যদি তুমি বিয়ে করো বা না করো, তুমি উভয়ের জন্যই অনুশোচনা করবে।’
সোরেন কিয়ের্কিগার্ডের কথার অবিকল বাংলা ভাষায় একটি প্রবাদ আছে, বিয়ে হলো ‘দিল্লি কা লাড্ডু’, মানে খেলেও পস্তাতে হবে, না খেলেও পস্তাতেও হবে। তবু মানুষ বিয়ে করে, বিয়ে করতে হয়। বিয়ে করতে হয় শুধু সামাজিক বন্ধনের জন্য নয়, বিয়ে আধুনিক সমাজসভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।
বিয়েকে আধ্যাত্মিক পুনর্মিলন হিসেবে দেখেছেন পুরাণতত্ত্ববিদ জোসেফ ক্যাম্পবেল। ‘পাওয়ার অব মিথ’ গ্রন্থে তিনি বলেছেন, বিয়ে প্রেমের সম্পর্কের চেয়ে আলাদা। বিয়ের সঙ্গে কোনো সম্পর্কের তুলনা হতে পারে না। এটি অভিজ্ঞতার এক পৌরাণিক স্তর। সমস্ত প্রেমের সম্পর্কই হতাশায় শেষ হয়। কিন্তু বিয়ে হলো একটি আধ্যাত্মিক পরিচয়ের স্বীকৃতি। আমরা যদি সঠিক জীবনযাপন করি, বা আমাদের মন বিপরীত লিঙ্গের মানুষটির প্রতি সঠিক গুণাবলি আরোপ করতে পারে, তাহলে আমরা নিজেদের মধ্যে সঠিক পুরুষ বা নারীর প্রতিরূপ খুঁজে পাব। কিন্তু আমরা যদি শুধু ইন্দ্রিয়গত স্বার্থের দিকটি দেখি, তাহলে আমরা ভুল ব্যক্তিকে বিয়ে করব। সঠিক ব্যক্তিকে বিয়ে করে প্রকৃত প্রস্তাবে আমরা ঈশ্বরেরই রূপ পুনর্গঠন করে থাকি, এটাই বিয়ে।
বিবাহের সম্পর্ক মূলত সভ্যতার সঙ্গে জড়িত। সমাজসভ্যতার বিকাশ একেক অঞ্চলে একই সময়ে বা একই রকম হয়নি। বিবাহের ইতিহাস কতটা পুরোনো সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট ইতিহাস জানা যায়নি। তবে ইতিহাসবিদ ও নৃবিজ্ঞানীরা একমত যে, শিকারি জীবন থেকে মানুষ যখন কৃষিসভ্যতার দিকে যায়, তখনই মূলত বিবাহপ্রথার প্রচলন। সে হিসাবে বিবাহের ইতিহাস বলতে গেলে ৪ হাজার ৩৫০ বছর পুরোনো। এর আগে হাজার হাজার বছর ধরে পরিবারগুলোতে ৩০ জনের মতো লোকের একটি অসংগঠিত দল ছিল, যার মধ্যে বেশ কয়েকজন পুরুষ নেতা একাধিক নারীকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিত। এটা ছিল যৌথ ব্যবস্থা। তাদের সন্তানরাও ছিল যৌথ পিতার স্বীকৃত উত্তরাধিকার। শিকারি-সংগ্রাহকরা কৃষিভিত্তিক সভ্যতায় বসতি স্থাপন করার সঙ্গে সঙ্গে সমাজের আরও স্থিতিশীল ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল।
এই স্থিতিশীল ব্যবস্থার জন্যই একক বিবাহকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়। একজন নারী ও একজন পুরুষকে একত্রিত করার জন্য বিবাহ অনুষ্ঠানের প্রথম রেকর্ডকৃত প্রমাণ পাওয়া যায় মেসোপটেমিয়ায় (বর্তমান ইরাক) প্রায় ২ হাজার ৩৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। পরবর্তী কয়েকশ বছর ধরে প্রাচীন হিব্রু, গ্রিক এবং রোমানদের মধ্যে এই প্রথা বিস্তৃত হয়। সেই সময়ে অবশ্য বিয়ের সঙ্গে প্রেম বা ধর্মের খুব একটা সম্পর্ক ছিল না। বিয়ের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল নারীদের পুরুষের সঙ্গে আবদ্ধ করা। একইভাবে নিশ্চিত করা যে, একজন পুরুষের সন্তান সত্যিকার অর্থে তার জৈবিক উত্তরাধিকারী। বিয়ের মাধ্যমে একজন নারী একজন পুরুষের সম্পত্তি হয়ে ওঠে। প্রাচীন গ্রিসের বিবাহ অনুষ্ঠানে একজন বাবা তার মেয়েকে এ কথাগুলো দিয়ে স্বামীর কাছে হস্তান্তর করতেন—‘আমি আমার মেয়েকে বৈধ সন্তান উৎপাদনের উদ্দেশ্যে নিয়ে তোমার কাছে সমর্পণ করলাম।’ তার মানে বিয়ের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সন্তান উৎপাদন।
প্রাচীন হিব্রুদের মধ্যে পুরুষরা একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করতেন। বিবাহিত গ্রিক এবং রোমান পুরুষরা উপপত্নী, পতিতা এবং এমনকি কিশোর প্রেমিকদের সঙ্গে তাদের বাসনা পূরণ করতে পারতেন। স্ত্রীরা যদি সন্তান উৎপাদন করতে ব্যর্থ হতেন, তাদের স্বামীরা সন্তানদের ফিরিয়ে দিতে পারতেন এবং অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারতেন।
অন্যদিকে ভারত যেহেতু ইন্দো-ইউরোপীয় সভ্যতার একটি অংশ, সে ক্ষেত্রে প্রাচীন গ্রিক ও রোমানদের বিয়ে প্রথার মধ্যে ভারতীয় সমাজেও কোনো উনিশ-বিশ ছিল না। ভারতীয় পুরাণ অনুযায়ী মহর্ষি উদ্দালক-পুত্র শ্বেতকেতু এই বিবাহ প্রথা চালু করেন। তবে কবে এই প্রথার শুরু হয়, সে সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। ভারতে আর্যদের আগেও দ্রাবিড়দের বাস ছিল। দ্রাবিড়দের সভ্যতা ও সংস্কৃতি ছিল রীতিমতো উচ্চ ধরনের। তারও আগে বহু জাতি নানারকম সভ্যতা ও সংস্কৃতি নিয়ে এদেশে বাস করে গেছে। আর্যপূর্ব নাগ প্রভৃতি জাতির সঙ্গে ব্রাহ্মণদের আর্য জাতির বিয়ে হতো বলে ধারণা করা হয়। বৈদিক যুগেই বর-কন্যার বিয়ে হতো যৌবনে। তখনো জাতিভেদ প্রবর্তিত হয়নি এবং প্রবর্তিত হয়ে থাকলেও তার তেমন বিধিনিষেধ ছিল না। বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিবাহ হলেও সামাজিক কোনো অসুবিধা হতো না। আর্যরা এসেই মূলত এই জাতিভেদ প্রথার প্রচলন করেন। কারণ তারা চাইতেন না, অনার্য বা ‘বর্বর’ জাতির সঙ্গে মিশে তাদের রক্তের বিশুদ্ধতা নষ্ট হোক।
আর্যদের আগমনের আগে ভারতে বিবাহ প্রথা প্রচলিত থাকলেও বিবাহ অনুষ্ঠানের উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের সূচনাপর্বে রচিত কৃষ্ণযজুর্বেদে। এর তৈত্তিরীয়সংহিতায় বলা আছে, পিতা তার কন্যাকে অন্য একটি পরিবারকে দান করেন। মানে একক কোনো ব্যক্তিকে নয়, দান করা হয় পরিবারকে। বেশ কয়েক শতাব্দী পর এই রীতির অস্তিত্ব মেলে তৈত্তিরীয় শাখারই আপস্তম্ব ধর্মসূত্রে। যেখানে বলা হয়েছে, নারীদের অন্য একটি কুলে দান করা হয়, কোনো ব্যক্তিকে নয়। আদি মধ্যযুগের স্মৃতিচন্দ্রিকা গ্রন্থে উদ্ধৃত বৃহস্পতি ধর্মশাস্ত্রেও এই রীতির উল্লেখ রয়েছে। মহাভারতে উল্লিখিত দ্রৌপদীর সঙ্গে পাণ্ডব ভ্রাতাদের বিবাহও এই প্রাচীন প্রথার স্মারক। ‘দেবর’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থও এই প্রাচীন বিবাহ প্রথার ইঙ্গিতবাহক। দেবর মানে ‘দ্বিবর’ বা ‘দ্বিতীয় বর’। অর্থাৎ স্ত্রীর মালিকানার দাবিদার স্বামীর অন্য ভায়েরাও। সভ্যতার ক্রমবিকাশের ফলে এই প্রথার বিলোপ ঘটিয়ে একক বিবাহের দিকে রূপ নেয়। তবে চীনের তিব্বতে এই প্রথা এখনো বিদ্যমান। যেখানে পরিবারের এক বা একাধিক কন্যাকে আরেক পরিবারের সব ভাইয়ের মধ্যে অর্পণ করা হয়। অর্থাৎ বিয়ে হয় ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির নয়, পরিবারের সঙ্গে পরিবারের।
প্রাচীন ভারতে প্রথম দিকে বিয়ের ক্ষেত্রে কন্যার সম্মতি নেওয়াকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো। রামায়ণ ও মহাভারতে স্বয়ম্ভর সভার কথা উল্লেখ আছে। যেখানে কন্যা নিজেই তার পতি নির্বাচন করতেন। কারণ বৈদিক সমাজে নারীরা সহজেই বিচরণ করতেন। তারা ঘরে বন্দি থাকতেন না। ‘মহিলা’ শব্দটি এসেছে, যারা মহলে বা ঘরে থাকতেন। বৈদিক সমাজে এই শব্দের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। তার পরিবর্তে পাওয়া যায় ‘বনিতা’ শব্দটি। অর্থাৎ নারীরা সে সময় যাগ-যজ্ঞে অংশগ্রহণ করতেন। তারা বেদমন্ত্রও রচনা করেছেন। অথর্ব বেদে নারীদের উপনয়ন ও ব্রহ্মচার্যের কথা আছে। বেদে নারীদের শিক্ষার অধিকারও ছিল। নৃত্য-গীত ছিল তাদের অবশ্যকীয় একটি শিক্ষা। বিয়ের ক্ষেত্রেও নারীরা পছন্দের পুরুষকে বেছে নিতে পারতেন। পরে যখন জাতিভেদ প্রথা সমাজে ভালো করে গেঁথে গেল, তখন সমাজপতিরা ছেলে-মেয়েদেরই পছন্দের ওপর বিয়ের ব্যাপারটা ছেড়ে দেওয়া বন্ধ করে দিলেন। কারণ বর-কনের পছন্দ তো আর জাতি-কুল বেছে হয় না! নামে বর থাকলেও বরণ প্রথাটি একেবারে অস্তাচলে গেল।
নিজেদের পছন্দে বিয়ের পরিবর্তে গুরুজনদের ব্যবস্থা অনুসারে অপ্রাপ্তবয়স্ক বর-কন্যাকে বিয়ে দেওয়ার প্রথা প্রবর্তিত হলো। আর্যদের মধ্যে ছিল পুরুষের প্রাধান্য। অন্যদিকে, দ্রাবিড়দের সামাজিক ব্যবস্থাতে মেয়েরাই ছিল মুখ্য। মেয়েরা ফুঁ দিয়ে যজ্ঞাগ্নি জ্বালাতেন। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, দ্রাবিড় কন্যারা ছিলেন স্বেচ্ছাবিহারিণী। হয়তো এ কারণে জাতিভেদ প্রথা প্রচলন করা হয়। একই সঙ্গে আর্য বর-কন্যাদের বিয়ের বয়সও সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়। তবে বিয়ের সময় বধূর মধ্যে পাঁচটি আকাঙ্ক্ষিত গুণ থাকতে হতো। বিত্ত, রূপ, শিক্ষা, বুদ্ধি এবং সদ্বংশ।
বৈদিক যুগেরও আরও পরে মনুস্মৃতিতে (খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয়-তৃতীয় শতকে রচিত বলে কথিত) বিয়ে নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে। মনু আট প্রকারের বিয়ের কথা বলেছেন। এগুলো হলো- ব্রাহ্ম, দৈব, আর্ষ, প্রাজাপত্য, আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ। এর মধ্যে পৈশাচ সবচেয়ে নিকৃষ্ট। এই আট প্রকার বিয়ের মধ্যে ব্রাহ্মণদের জন্য প্রথম ৬ প্রকার, অর্থাৎ, ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য, আসুর ও গান্ধর্ব; ক্ষত্রিয়দের জন্য শেষ ৪ প্রকার, অর্থাৎ, আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ এবং বৈশ্য ও শুদ্রদের জন্য কেবল আসুর, গান্ধর্ব ও পৈশাচ ধর্মসম্মত।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও আট প্রকারের বিয়ের উল্লেখ রয়েছে। অর্থশাস্ত্র অনুযায়ী, প্রথম চার প্রকারের বিয়ের ক্ষেত্রে কেবল কন্যার পিতা স্বীকার করলেই সেই বিয়ে ধর্ম বা আইনসম্মত হবে। শেষ চার প্রকারের বিয়ের ক্ষেত্রে কন্যার পিতা ও মাতা উভয়ে স্বীকার করলে তবে ওই বিয়ে ধর্মসম্মত হবে। অর্থশাস্ত্রের মতে, আসুর বিবাহে কন্যাশুল্ক (কন্যাপণ) কন্যার পিতা ও মাতা উভয়কেই দিতে হবে; কেবলমাত্র একজনের অবর্তমানে অন্যজন সম্পূর্ণ পরিমাণ শুল্ক পাবেন। কোনো কন্যার দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ কন্যাশুল্ক তিনি একা পাবেন।
প্রাচীন ভারতীয়দের মতো সেমেটিক ধর্মেও (মুসলিম, খ্রিষ্টান ও ইহুদি) বিয়ে প্রথাকে অত্যন্ত পবিত্র হিসেবে দেখা হয়। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ককে সব ধর্মেই ঘৃণ্য মনে করা হয়। এমন ‘ব্যভিচারের’ কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে এসব ধর্মে। তবে আধুনিক সমাজে সব ধর্মেই বিয়ের জন্য নারী-পুরুষের পছন্দকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। খ্রিষ্টান সমাজে, বিশেষ করে ইউরোপে ১১৪০ সালে নতুন আইন পাস করে গির্জা। যেখানে, বিয়ের বিষয়ে বর এবং কনে উভয়ের সম্মতির ওপর জোর দেওয়া হয়। ক্ষেত্র বিশেষে কিছু ব্যতিক্রম বাদে, এই প্রথা বা আইন এখন সব সমাজেই প্রায় স্বীকৃত।
উপসংহার: বিয়ের সময় হিন্দু নবদম্পতি একটি মন্ত্র উচ্চারণ করেন, ‘যদিদং হৃদয়ং তব/তদিদং হৃদয়ং মম’। অর্থাৎ ‘তোমার হৃদয় আমার হোক/আমার হৃদয় তোমার হোক/আমরা এক হৃদয় হই।’ বিয়ে শুধু সামাজিক বন্ধনই নয়, এটি হৃদয়েরও বন্ধন। বিবাহের আরেকটি পরিভাষায় আছে ‘উদ্বাহু’। এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বাহু বা হাতকে ওপরে তুলে ধরা। মানে আত্মসমর্পণ। অর্থাৎ বিবাহ মানে বর-কনে একে অপরের প্রতি আত্মসমর্পণ। যে কোনো মত বা চিন্তার বিরোধ তৈরি হতে পারে দুজনের মধ্যে, এসব বিরোধ দূরে সরিয়ে রেখে দম্পতি যদি একে অপরের প্রতি আত্মসমর্পণ করেন, তাহলে তাদের জীবন ও সংসার সুখের হয়, আনন্দময় হয়, এমনটাই বলে আসছেন বিজ্ঞজনরা।