অপরাধীকে ক্ষমা প্রদর্শনে রাষ্ট্রপতি ও নির্বাহী বিভাগের একচ্ছত্র ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করেছে বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন। তাদের সুপারিশে বলা হয়েছে, ‘ক্ষমা প্রদর্শন আইন নামে একটি আইন প্রণয়ন করা হবে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ অন্যান্য সব নির্বাহী ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতা এই আইনের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হবে। ক্ষমা প্রদর্শন আইনের মাধ্যমে একটি ক্ষমা প্রদর্শন বোর্ড গঠিত হবে। রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেলের নেতৃত্বে ৬ সদস্যের এই বোর্ডে ক্ষমা প্রদানের জন্য গৃহীত সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি বা সংশ্লিষ্ট নির্বাহী বিভাগ ক্ষমা প্রদর্শন করবে। তবে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিসে আইন কর্মকর্তা নিয়োগ কীভাবে হবে এবং এই সার্ভিস থেকে হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ কীভাবে হবে, সে বিষয়ে কমিশনের তিনজন সদস্য দ্বিমত পোষণ করেছেন। পাশপাশি তারা অধস্তন আদালতের বিচারকদের মধ্য থেকে হাইকোর্ট বিভাগে ৫০ শতাংশ অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়োগের সুপারিশ করেছেন। তাদের সুপারিশও কমিশনের প্রতিবেদনে যুক্ত করা হয়েছে। তবে ভিন্নমতের ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের মতামত প্রাধান্য পেয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
গতকাল বুধবার কমিশনের প্রধান আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানের নেতৃত্বে বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করে। প্রতিবেদনে ক্ষমা প্রদর্শনে রাষ্ট্রপতির একচ্ছত্র ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণসহ ৩০টি বিষয়ে সুপারিশ করেছে। কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি এমদাদুল হক, ফরিদ আহমেদ শিবলী, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ মাসদার হোসেন ও সৈয়দ আমিনুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহফুজুল হক সুপন, ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন শাওন ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আরমান হোসাইন।
বিচার বিভাগের প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রস্তাব করতে গত ৩ অক্টোবর আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমানের নেতৃত্বে আট সদস্যের সংস্কার কমিশন গঠন করে সরকার। এরপর থেকেই কমিশন সরেজমিন বিভিন্ন আদালত পরিদর্শন, মতবিনিময়সহ নানা কার্যক্রম গ্রহণ করে। দীর্ঘ আলোচনা-পর্যালোচনার পর বিচার বিভাগের মোট ৩০টি বিষয়ে সংস্কারের প্রস্তাব করে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে কমিশন।
প্রতিবেদনে সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগ ও শৃঙ্খলা, অধস্তন আদালতে বিচারক নিয়োগ ও চাকরির শর্তাবলি, সুপ্রিম কোর্টে আলাদা সচিবালয় স্থাপন, আদালত ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ, স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা, স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সংস্থা গঠন, বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি লাঘব, দুর্নীতি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, আইনগত সহায়তা কার্যক্রম ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা কার্যকর করা, প্রচলিত আইনের, আইন পেশার ও আইন শিক্ষার সংস্কার, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রতিরোধ, মামলার জট হ্রাস, মোবাইল কোর্টে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের সাজা প্রদানের ক্ষমতা রহিত করা, গ্রাম আদালতের ভুল-ত্রুটি দূর করা, বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করাসহ মোট ৩০টি বিষয়ে সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া কমিশন সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ কমিশন অধ্যাদেশ, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস সদস্যদের আচরণবিধিমালা এবং আইনগত সহায়তা ও মধ্যস্থতা সেবা প্রদান অধ্যাদেশ নামে তিনটি অধ্যাদেশের খসড়াও প্রস্তুত করে দিয়েছে। এসব খসড়া কমিশনের প্রতিবেদনের সঙ্গে জমা দেওয়া হয়েছে।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন শাওন কালবেলাকে বলেন, ‘কমিশন ৩০টি বিষয়ে আলোকপাত করেছে। একটি সারসংক্ষেপও জমা দেওয়া হয়েছে। এখন জাতীয় ঐক্য কমিশন এই সুপারিশগুলো নিয়ে কাজ করবে। বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে বিচারপতি এমদাদুল হক ঐক্য কমিশনের সঙ্গে কাজ করবে। সুপারিশের মধ্যে কোনগুলো স্বল্পমেয়াদি ও কোনগুলো দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবায়নযোগ্য, তা বিশ্লেষণ করবে। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এসব নিয়ে বৈঠক হবে।’
রাষ্ট্রপতির একচ্ছত্র ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ: বর্তমানে দণ্ড মার্জনা, দণ্ড মওকুফ, দণ্ড হ্রাস, দণ্ড স্থগিত এবং দণ্ড বিলম্বের বিষয়গুলো সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ এবং ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১, ৪০২ ও ৪০২ক ধারা অনুসারে পরিচালিত হয়। সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত কোনো দণ্ডের মার্জনা, বিলম্ব ও বিরাম মঞ্জুর করার এবং যে কোনো দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক এই শাস্তি হ্রাস বা ক্ষমতা প্রদর্শনের ক্ষমতা ব্যবহারের কিছু নিয়মনীতি লিখিত ও অলিখিতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব নিয়মনীতির পেছনে বিভিন্ন দেশের উচ্চ আদালতেরও ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকার যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতার অপব্যবহার করছে, তা সর্বজনবিদিত উল্লেখ করে তা নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়ন ও বোর্ড গঠনের কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, ক্ষমা প্রদর্শন বোর্ড বছরে ন্যূনতম দুইবার জানুয়ারি ও জুলাইয়ে সভায় মিলিত হবে। সরকার বোর্ডের সভা অনুসারে সদস্যদের জন্য সম্মানীর ব্যবস্থা করবে। আগ্রহী দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তি নির্ধারিত ফরমে অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি বরাবর ক্ষমা প্রদর্শনের আবেদন করবেন। আবেদন যাচাই-বাছাই করে অ্যাটর্নি জেনারেল ক্ষমা প্রদর্শন বোর্ডের সভা আহ্বান করবেন। ক্ষমাপ্রাপ্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণে বোর্ড একমত না হতে পারলে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। গৃহীত সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতি বা সংশ্লিষ্ট নির্বাহী দপ্তরকে অবহিত করা হবে। বোর্ডে গৃহীত সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি বা সংশ্লিষ্ট নির্বাহী বিভাগ ক্ষমা প্রদর্শন করবে। এ ক্ষেত্রে অপরাধের মাত্রা ও ধরন, অপরাধীর আচরণ বিবেচনাসহ ১০ বিষয় অনুসরণেরও সুপারিশ করেছে কমিশন।
কমিশনের তিন সদস্যের ভিন্নমত: স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিসের নিয়োগ, এই সার্ভিস থেকে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক নিয়োগের সুযোগ রাখা এবং সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিচার-কর্মবিভাগে (অধস্তন আদালতে) নিয়োজিত জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যদের নিয়োগের ব্যাপারে কমিশনের তিনজন সদস্য ভিন্নমত পোষণ করেছেন। ভিন্নমত পোষণকারী তিনজন হলেন বিচারপতি ফরিদ আহমদ শিবলী, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ মাসদার হোসেন এবং সাবেক জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ আমিনুল ইসলাম।
ভিন্নমত পোষণকারী তিনজন মতামতে বলেছেন, ‘আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সরকারি স্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। প্রস্তাবিত অ্যাটর্নি সার্ভিসে নিয়োগকৃত সদস্যদের যোগ্যতা, কাজের মান ও দক্ষতাসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিরীক্ষণ ও মূল্যায়ন না করে ওই সার্ভিসের সদস্যদের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক হিসেবে নিয়োগের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে এ মুহূর্তে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন তথা সংবিধান সংশোধনের যে কোনো ধরনের প্রস্তাব প্রেরণ করা সমীচীন হবে না। এ ছাড়া সরকারি কর্ম কমিশনের পরিবর্তে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে প্রস্তাবিত অ্যাটর্নি সার্ভিসের সদস্য নিয়োগ এবং এর কার্যপরিধি বাড়িয়ে ‘লিগ্যাল অ্যান্ড বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন’ নামকরণ কোনো অবস্থাতেই বাস্তবসম্মত নয়। সর্বোপরি এরূপ উদ্যোগ মাসদার হোসেন মামলায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশনার পরিপন্থি।’
এই তিন বিচারক হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগের ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তারা তাদের মতামতে বলেছেন, বিগত ১৫ বছরে নিয়োগকৃত বিচারকের মধ্যে বিচার-কর্মবিভাগের সদস্যদের (অধস্তন আদালত থেকে) মধ্য থেকে নিয়োগ হয়েছে মাত্র ৩৩ শতাংশ। এটি স্পষ্টতই একটি বৈষম্য। এ বিষয়ে হাইকোর্টে বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে অ্যাডভোকেট এবং বিচার কর্মবিভাগের সদস্যদের অনুপাত ৫০ শতাংশ করে নির্ধারণ করার সুপারিশ করেছেন তারা।
তাদের দেওয়া সুপারিশে বলা হয়েছে, ২০০৮ সালে অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকারি অ্যাটর্নি সার্ভিস অধ্যাদেশ, ২০০৮ নামে যে অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি হয়েছিল, সেটির কাঠামো ও নিয়োগ বিধান অনুসরণ করে অ্যাটর্নি সার্ভিসের নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। প্রস্তাবিত অ্যাটর্নি সার্ভিসে নিয়োগকৃত সদস্যদের যোগ্যতা, কাজের মান ও দক্ষতাসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিরীক্ষণ ও মূল্যায়ন না করে ওই সার্ভিসের সদস্যদের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক হিসেবে নিয়োগের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে এ মুহূর্তে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন তথা বাংলাদেশ সংবিধান সংশোধনের কোনো ধরনের প্রস্তাব প্রেরণ করা সমীচীন হবে না। সরকারি কর্ম কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে প্রস্তাবিত অ্যাটর্নি সার্ভিসে নিয়োগ প্রদান করতে হবে। হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে অ্যাডভোকেট এবং বিচার-কর্মবিভাগের সদস্যদের অনুপাত ৫০:৫০ নির্ধারণ করতে হবে। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক হিসেবে কর্মরত বিচার-কর্মবিভাগের ন্যূনতম একজন সদস্যকে সর্বদা আপিল বিভাগে নিয়োগের বিধান প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে সন্নিবেশিত করতে হবে। পৃথক অ্যাটর্নি সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা যেন জেলা পর্যায়ে বিচারকদের সমান বা বেশি না হয় বা ওই সার্ভিসের মাধ্যমে বিচারকদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন না হয়, সেই বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে।