বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে তিন দফায় জালিয়াতি করে ও নিয়ম ভেঙে ৯৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে ৫১ জনকে ও ‘জব স্পেসিফিকেশন ম্যানুয়াল’ লঙ্ঘন করে ৪৩ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় সংস্থাটির কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। তারা পদোন্নতিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন।
নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর বাণিজ্যিক তত্ত্বাবধায়ক পদ থেকে ৮১ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। জব স্পেসিফিকেশন ম্যানুয়াল অনুযায়ী এসব কর্মকর্তা চলতি বছরের ২৯ ডিসেম্বর অর্থাৎ পূর্বের পদোন্নতির তিন বছর পর ফের পদোন্নতির জন্য বিবেচিত হওয়ার কথা; কিন্তু তার আগেই গত বছরের ৬ জুন নিয়মের তোয়াক্কা না করেই তাদের আগের পদোন্নতিকে ব্যাক ডেট দেখিয়ে অর্থাৎ জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে ৫১ জনকে পদোন্নতি দেয় বিমান। অথচ তাদের সঙ্গে থাকা কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে বিমানে রীতিমতো হৈচৈ পড়ে গেছে।
কর্মকর্তারা জানান, পদোন্নতির জন্য বর্তমান পে-গ্রুপে ন্যূনতম ৩ বছর চাকরি করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা অনুসরণ না করে বিধিবহির্ভূতভাবে বিমানের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইওর বিশেষ ক্ষমতাবলে বেআইনিভাবে ৫১ জন কর্মকর্তাকে জ্যেষ্ঠতা প্রদান করেন। এতে সরাসরি বৈষম্যের শিকার হয়েছেন তাদের সঙ্গে একই সময়ে চাকরিতে যোগদানকারী এবং একই সময়ে বর্তমান পে-গ্রুপে পদোন্নতিপ্রাপ্ত বাকি কর্মকর্তারা।
তারা জানান, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন বিভাগ, পরিচালক (প্রশাসন), মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন), পরিচালকের (বিপণন ও বিক্রয়) কাছে বারবার আবেদন ও প্রতিবাদ করেও পদোন্নতির প্রক্রিয়া থামানো যায়নি।
বঞ্চিত কর্মকর্তারা বলেন, বৈষম্যহীন দেশ গঠনের শপথে গঠিত এই সরকারের নির্বাচিত বিমান ম্যানেজমেন্টের কাছে বিমানকর্মীদের দাবি—বাংলাদেশ বিমানের পদোন্নতি পলিসি অনুসরণ করে এবং যোগ্যতার অন্যান্য বিষয় পর্যাপ্ত পর্যালোচনার ভিত্তিতে সব পদোন্নতির স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
জানা গেছে, এই পদোন্নতি নথিতে বিপণন ও বিক্রয় বিভাগের বেতনক্রম ৫ থেকে বেতনক্রম ৬ এ পদোন্নতির তালিকা অন্তর্ভুক্ত আছে। বিক্রয় ও বিপণনের ৫১ জন প্রার্থীর বর্তমান পে-গ্রুপ-৫ এ এখনো তিন বছর মেয়াদ পূর্ণ হয়নি। ২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বরে একই সঙ্গে পে-গ্রুপ ৫ এ পদোন্নতি পাওয়া ৮১ জন থেকে ৫১ জনকে নিয়মের তোয়াক্কা না করেই মাত্র দেড় বছরের মাথায় পদোন্নতি দেওয়া হয়। ৫০টি শূন্য পদের বিপরীতে কমপক্ষে ১৫২ (কমপক্ষে তিনগুণ) জনকে মৌখিক পরীক্ষায় ডাকার বিধান রয়েছে; কিন্তু এ বিধান অনুসরণ না করে ৫১টি শূন্য পদের বিপরীতে ৫১ জনকেই ডাকা হয়, যেন এই তালিকাভুক্তরা কোনোরকম প্রতিযোগিতার মুখে না পড়ে।
এ বিষয়ে খোঁজ নেবেন বলে কালবেলাকে জানিয়েছেন বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ড. সাফিকুর রহমান।
অডিট আপত্তিতে ৪৩ জনের পদোন্নতি:
জব স্পেসিফিকেশন ম্যানুয়ালের শর্ত লঙ্ঘন করে আরও ৪৩ জনের পদোন্নতির অনিয়ম পেয়েছে বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে গত ৯ জানুয়ারি বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইওকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
অডিট আপত্তিতে বলা হয়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেডের জব স্পেসিফিকেশন ম্যানুয়াল, প্রশাসন ও মানবসম্পদ পরিদপ্তর থেকে জারিকৃত পদোন্নতির আদেশ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য নথিপত্র নিরীক্ষা করা হয়। এতে দেখা যায়, জব স্পেসিফিকেশন ম্যানুয়ালের চ্যাপ্টার ৪ এর ৪.১ অনুযায়ী কনিষ্ঠ কর্মকর্তা (প্রশাসন) (পে-গ্রুপ-৫) থেকে সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) (পে-গ্রুপ-৬) পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে কনিষ্ঠ কর্মকর্তা (প্রশাসনিক) (পে-গ্রুপ-৫) পদে কমপক্ষে ৩ বছরের অভিজ্ঞতা এবং বিএটিসি থেকে জুনিয়র ম্যানেজমেন্ট কোর্স সম্পন্ন করতে হয়। চ্যাপ্টার-৫ এর ৫.১ অনুযায়ী কনিষ্ঠ (বাণিজ্যিক) (পে-গ্রুপ ৫) পদে কমপক্ষে ৩ বছরের অভিজ্ঞতা এবং বিএটিসি থেকে জুনিয়র ম্যানেজমেন্ট কোর্স সম্পন্ন করতে হবে। অথচ নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গত বছরের ১৬ অক্টোবর ২২ জন কর্মচারীকে কনিষ্ঠ কর্মকর্তা (প্রশাসন) (পে গ্রুপ-৫) পদে ৩ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই (১ বছর ৯ মাস ১৭ দিন পর) সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) (পে-গ্রুপ-৬) পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। একই তারিখে আরও ২১ কর্মচারীকে কনিষ্ঠ কর্মকর্তা (বাণিজ্যিক) (পে-গ্রুপ-৫) পদে ৩ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই (১ বছর ৯ মাস ১৭ দিন) সহকারী ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) (পে-গ্রুপ-৬) পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ফলে জব স্পেসিফিকেশন ম্যানুয়ালের চ্যাপ্টার ৪ এর ৪.১ এবং চ্যাপ্টার-৫ এর ৫.১ লঙ্ঘিত হয়েছে।
অডিট আপত্তি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সাফিকুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘আমার কাছে যেসব অভিযোগ কিংবা আপত্তি আসে আমি তা পরিচালককে (অর্থ) পাঠিয়ে দিই। তারা ব্যবস্থা নিয়ে আমাকে জানাবেন।’
পরিচালক (অর্থ) মো. নওসাদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা অডিট আপত্তি নিয়ে কাজ করছি। বিষয়টি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। অডিট অফিসে নথিপত্র পাঠাব। তারপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।’