রাজধানীর বিভিন্ন থানায় দায়ের হওয়া ৫১টি হত্যা মামলার বিচার করেছেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩। গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে ঘোষিত হয়েছে এসব মামলায় রায়। ২০০০ সালের আগে দায়ের করা এসব হত্যা মামলার রায়ে ‘মহাবিপর্যয়’ ঘটে গেছে। মামলাগুলোর মোট ২১৫ আসামির মধ্যে ২১৪ জনই বেকসুর খালাস পেয়ে গেছেন। শুধু সূত্রাপুর থানার একটি মামলায় নারায়ণ চন্দ্র দেবনাথ নামে এক আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
মামলার রায়গুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১০টি মামলায় একজন সাক্ষীও হাজির করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। মামলার বাদী, পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তা, ময়নাদন্তকারী চিকিৎসক কেউই হাজির হননি সাক্ষ্য দিতে। ৯টি মামলায় মাত্র একজন করে সাক্ষী হাজির করতে পেরেছে রাষ্ট্রপক্ষ। দুজন করে সাক্ষী হাজির করেছে ৭টি মামলায়। আর তিনজন করে সাক্ষী হাজির করেছে ৮টি মামলায়। বাকি ৩২টি মামলায় অল্প কিছু সাক্ষী হাজির হলেও অধিকাংশ মামলার বাদী ও অভিযোগকারী, সুরতহাল রিপোর্ট, লাশের চালান, ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক, অভিযোগপত্র দাখিলকারী তদন্তকারী কর্মকর্তা রেকর্ডিং অফিসার, জব্দ তালিকার পাবলিক সাক্ষীসহ অন্য কোনো প্রত্যক্ষদর্শীকে আদালতে হাজির করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ।
আদালতে থেকে এসব সাক্ষী হাজির করতে বারবার তাগাদা দেওয়া হয়েছে। জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে সাক্ষীদের নামে। সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য কিছু কিছু মামলায় তারিখ পড়েছে একশ থেকে দেড়শবার। কিন্তু কোনোভাবেই সাক্ষী হাজির করতে পারেনি প্রসিকিউশন। ফলে এসব পুরোনো মামলার ভার আর নিতে চাননি আদালত। দুই যুগ থেকে শুরু করে ৩০ বছরের অধিক পুরোনো এসব মামলা একপর্যায়ে বাধ্য হয়েই আদালত রায় দিয়েছেন। সাক্ষীর অভাব আর মামলাগুলোতে আসামিদের কোনো স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি না থাকায় এসব রায়ে অভিযুক্ত সব আসামিই খালাস পেয়ে গেছেন।
আদালত বেশিরভাগ রায়ে উল্লেখ করেছেন, ‘আদালতে হাজির করার জন্য সাক্ষীদের একাধিকবার প্রসেস (সাক্ষীর সমন) প্রেরণসহ জামিন
অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা (এনবিডব্লিউডব্লিউ) এবং একাধিকবার আদেশের অনুলিপি সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের বরাবর প্রেরণ করা হয়েছে। সাক্ষীদের আদালতে হাজির করার দায়িত্ব রাষ্ট্রপক্ষের তথা পুলিশ কর্তৃপক্ষের ওপর বর্তায়। কেননা ১৮৯৮ সালের সিআরপিসির ১৭১(২) ধারায় উল্লেখ আছে, মামলার শুনানিকালে আদালতে সাক্ষী হাজির নিশ্চিত করার দায়দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার ওপর বর্তাবে।’
এ ছাড়া রায়ে বলা হয়েছে, ‘হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা রয়েছে যে, ২০০০ সালের আগের মামলাগুলো নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। এমতাবস্থায় প্রসিকিউশন পক্ষ এই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত খুনের অভিযোগ সাক্ষ্যপ্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাক্ষী হাজির করতে না পারায় শত ছিদ্র ফুটে উঠেছে এসব হত্যা মামলায়। রাষ্ট্রপক্ষের নানা দুর্বলতা লক্ষ করা গেছে মামলাগুলোর রায় বিশ্লেষণে। হত্যা মামলার মতো স্পর্শকাতর মামলার বিচারে গতি না থাকা, মামলার বাদী ও অভিযোগকারী, তদন্তকারী কর্মকর্তা, ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকসহ মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে না আসা, দিনের পর দিন আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে চলাসহ নানা বিষয় ফুটে উঠেছে এসব রায়ে। এসব রায় বিচার ব্যবস্থার বড় দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এসব মামলার সঠিক বিচার হলে অধিকাংশ আসামিই সাজা পেতেন। কিন্তু বিচারের নামে এক ধরনের বিচারহীনতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এসব রায়ে। ফৌজদারি মামলার সূত্র ‘বিলম্বিত বিচার ন্যায়বিচারকে ব্যাহত করে’। আর এসব রায়ে তারই প্রতিফলন ঘটেছে বলেও মনে করছেন অনেকেই।
এসব মামলার বিচারের শুরুতে বাদী, আদালত এবং প্রিসিকিউশন পক্ষ তৎপর থাকলে অধিকাংশ মামলায় সাজা হতো বলে মনে করেন এই ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের আইন কর্মকর্তা পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. মাহবুবুর রহমান।
তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘হাইকোর্টের একটা নির্দেশনা ছিল ২০০০ সালের আগের মামলাগুলো একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। সে কারণে এসব পুরোনো মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩-এ পাঠানো হয়। বিচার চলাকালে দেখা যায়, এ মামলার অনেক বাদী, সাক্ষী, ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার মারা গেছেন। অনেক সাক্ষী বিদেশে চলে গেছেন। অনেক সাক্ষী অবসরে গেছেন। অনেকের ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেক মামলায় বাদীও নেই, সাক্ষীও নেই। এসব কারণে সাক্ষী হাজির করা সম্ভব হয়নি। ফলে মামলাগুলোর আসামিরা খালাস পেয়ে গেছেন।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মামলাগুলোর দ্রুত বিচার হওয়া উচিত ছিল। বিচার প্রক্রিয়ার শুরু থেকে বাদী, প্রসিকিউশন ও আদালত সক্রিয় থাকলে অধিকাংশ মামলায় সাজা হতো।’
মামলাগুলো বিশ্লেষণে দেখা গেছে, খুনের এসব ঘটনা ১৯৯১ সাল থেকে ২০০০ সালের মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সংঘটিত হয়েছে। কাউকে গুলি করে, কাউকে আবার কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করেছে আসামিরা। কেউ কেউ খুন হয়েছেন সন্ত্রাসীদের বন্দুকযুদ্ধের মধ্যে পড়ে। তদন্তে খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রাথমিক সত্যতা পেয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীরা সাক্ষ্য না দেওয়ায় আসামিরা সব খালাস পেয়ে গেছে। রাজধানীতে ঘটে যাওয়া অর্ধশত খুনের ঘটনায় রাষ্ট্রপক্ষ কাউকেই অপরাধী হিসেবে প্রমাণ করতে পারেনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে অভিযুক্তরা গণহারে খালাস পেয়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো এক প্রকার অবিচারের শিকার হলো।
ঢাকা মহানগরের সাবেক পিপি ও ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ এহসানুল হক সমাজী কালবেলাকে বলেন, ‘সিআরপিসি’র অধীনে সাক্ষীকে হাজির করার সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এর পরও সম্ভব না হলে এবং সে ব্যাপারে কার্যবিধির ১১৭(২) ধারা অনুযায়ী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে তা উল্লেখপূর্বক সব প্রসেস জারি না হওয়ার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে হবে। সেই ব্যাখ্যা দেখে বিচারক মামলার গুণাগুণের ওপর ভিত্তি করে তা নিষ্পত্তি করতে পারেন। এর ব্যতিক্রম হলে আইনের ব্যত্যয় ঘটবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দ্রুত বিচার আইন ২০০২-এর ধারা ১০-এর অধীনে নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির কথা বলা আছে। আর নির্ধারিত সময়ে তা না পারলে মামলাটি আগের কোর্টে ফেরত পাঠাবে। এ ছাড়া প্রতিটি মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সিআরপিসির ৩৩৯(সি) ধারায়ও নির্দিষ্ট সময়ের উল্লেখ করা আছে। আইনে উল্লেখিত সময়সীমা এবং সুপ্রিম কোর্ট থেকে এর আগে মামলা জট কমানোর জন্য নির্দেশনার কোনো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। প্রতিটি মামলার বিচারের ক্ষেত্রে ক্রিমিনাল রুলস অ্যান্ড অর্ডার-২০০৯-এর বিধিবিধান যথাযথভাবে অনুসরণ করলে মামলার বিচার কার্যক্রম দ্রুততার সঙ্গে নিষ্পত্তি করা সম্ভব।’
উল্লেখযোগ্য যেসব মামলায় খালাস
ছোট ভাই হত্যার বিচার চেয়ে ১৯৯৭ সালের ১৯ মার্চ রাজধানীর সূত্রাপুর থানায় একটি মামলা করেন ইউসুফ ফকির। মামলার অভিযোগে বলা হয়, বাদীর ছোট ভাই সোহেল ফকির পরীক্ষায় পড়ার নোট আনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কলোনিতে যান। সেখান থেকে রওনা দিলে রাত অনুমান ৮টা ৪৫ মিনিটে কলোনির দক্ষিণ গেটের কাছে পৌঁছলে সেখানে ভেজালিয়া আলম ও বোন্দা গ্রুপের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যান। এই সময় আসামি ভেজালিয়া আলম, বোন্দা, সিরাজ, তাজু, রাঙ্গা, রানা ও অন্যদের এলোপাতাড়ি গুলিতে বাদীর ছোট ভাই নিহত হন।
মামলাটি বিচারের জন্য ২৫টি বছর আদালতে ঝুলে থাকে। সাক্ষীর জন্য ৭৫ বার তারিখ ধার্য হলেও রাষ্ট্রপক্ষ একজন সাক্ষীকেও আদালতে হাজির করতে পারেনি। রায়ে আদালত বলেছেন, ‘মামলার বাদী এবং তদন্তকারী কর্মকর্তা তথা রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের উপস্থাপন করার সব ধরনের সুযোগ পুলিশ পেয়েছে। সাক্ষীদের প্রতি প্রেরিত বিভিন্ন প্রসেস শেষ হয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়। মামলার পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সাক্ষ্যপ্রমাণ আদালত উপস্থাপিত না হওয়ায় ও মামলাটি অতি পুরোনো হওয়ায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে মামলাটির কার্যক্রম ফৌজদারি কার্যবিধির ২৬৫-এইচ ধারামতে সমাপ্ত করা হলো।’
কুলসুম বেগম মোহাম্মদপুর থানায় ২০০০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় বলা হয়, এলাকার আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে সন্ত্রাসীদের দুই গ্রুপের মধ্যে এবং পুলিশের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের গোলাগুলি চলছিল। পরে তার বাসার সামনে দাঁড়ানো অবস্থায় তার স্বামী চোখে গুলিবিদ্ধ হন। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান। এ মামলার পর ২৩ বছর পার হলেও একজন সাক্ষীকেও হাজির করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। ফলে সব আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
একইভাবে ১৯৯৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ডেমরায় খুন হন ফেরদৌস। ১৯ জনের মধ্যে তিনজন সাক্ষ্য দেন, খালাস দেওয়া হয় ১৩ আসামিকে। ১৯৯৮ সালে মতিঝিলে শিশু আওলাদ হত্যা মামলায় ২০ জনের মধ্যে একজন সাক্ষ্য দেন। এই মামলায় খালাস পান আট আসামি। ২০০০ সালে ক্যান্টনমেন্টের মাটিকাটায় হাশেম হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দেন ১৮ জনের মধ্যে তিনজন। রায়ে খালাস পান আটজন। ২০০০ সালে মোহাম্মদপুরে মিন্টু হত্যা মামলায় ১৯ জনের মধ্যে সাতজন সাক্ষ্য দেন; খালাস পান ১২ আসামি। ১৯৯৯ সালে শ্যামপুরে ভুট্টো হত্যা মামলায় ২৮ জনের মধ্যে সাক্ষ্য দেন একজন; খালাস পান সাত আসামি। পল্লবীতে ২০০০ সালে মনিরুজ্জামান হত্যা মামলায় ২৫ জনের মধ্যে সাক্ষ্য দেন তিনজন; খালাস পান আট আসামি।
১৯৯৯ সালে মালিবাগের চৌধুরীপাড়ায় খুন হন কায়েস। এই হত্যা মামলায় ১৭ জনের মধ্যে পাঁচজন সাক্ষ্য দেন; খালাস পান ছয় আসামি। মিরপুরে ২০০০ সালে রঞ্জু হত্যা মামলায় ১৪ জনের মধ্যে একজন সাক্ষ্য দেন; খালাস পান সাত আসামি। ২০০০ সালে শ্যামপুরে জাহাঙ্গীর হত্যা মামলায় ১৮ জনের মধ্যে পাঁচজন সাক্ষ্য দেন; খালাস পান আট আসামি। ২০০০ সালে ওয়াইজঘাটে হামিদ হত্যা মামলায় ১৩ জনের মধ্যে দুজন সাক্ষ্য দেন; খালাস পান সাত আসামি।
এভাবে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীরা সাক্ষ্য না দেওয়ায় কলাবাগানে মন্টি হত্যা মামরায় পাঁচজন, রূপনগরে লোকমান হত্যায় পাঁচজন, ডেমরায় হাসান হত্যায় ছয়জন, খিলগাঁওয়ে পান্না হত্যায় ছয়জন এবং সেনপাড়ায় লেবু হত্যা মামলায় তিন আসামিকে খালাস দেন বিচারক।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে বিপুলসংখ্যক আসামির খালাস পাওয়ার বিষয়টি বিচার ব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রতার ফসল। দীর্ঘ বিলম্বের মুখে পড়ায় নৃশংস এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত অপরাধীরা পার পেয়ে গেছেন। অপরাধীদের শাস্তি এবং ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে দ্রুত বিচার শেষ করতে হবে। আর এক্ষেত্রে মামলার বাদী, রাষ্ট্রপক্ষ ও আদালতকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।
মন্তব্য করুন