জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বৈঠকে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দলকে না ডেকে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছে ডাক না পাওয়া অনেক দল। তারা বলছেন, পতিত ফ্যাসিবাদের নানা ষড়যন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্য যেখানে জরুরি, সেখানে এর মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে কার্যত বিভাজন সৃষ্টি করছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, সরকারের সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হলে, কীসের ভিত্তিতে মাত্র সাতটি দলকে ডাকা হলো সরকারকে সেটা প্রকাশ করা উচিত। না হলে বৈষম্যবিরোধী ও কর্তৃত্ববাদবিরোধী আন্দোলনের শরিক অন্য দলগুলো হতাশ হয়ে পড়বে।
এদিকে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল মনে করে, সংস্কার ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো যাতে সরকারের সঙ্গে একমত হয়, সেজন্য দলগুলোর ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিবের উপস্থিতিতে সংস্কার কমিশনের সবাইকে রাখা হয়েছে। কারণ, এই সরকার নিজেরা নিজেদের যথেষ্ট শক্তিশালী কিংবা সক্ষম মনে করছে না।
শনিবার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ সাতটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেন সফররত জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। অন্য দলগুলো হলো নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। বৈঠকে দলগুলো সংস্কার এবং আগামী নির্বাচন ইস্যুতে নিজ নিজ দলীয় অবস্থান তুলে ধরে।
জাতিসংঘ ঢাকা কার্যালয় আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে ছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মুনির হায়দার। সেখানে ছিলেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান আলী রীয়াজ, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারবিষয়ক কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফররাজ হোসেন এবং জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী।
জানতে চাইলে ১২দলীয় জোটের প্রধান ও জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার কালবেলাকে বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যেসব রাজনৈতিক দল ছিল, তাদের সবাইকে জাতিসংঘ মহাসচিবের বৈঠকে ডাকা উচিত ছিল। বিদ্যমান অস্থির পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্য অত্যন্ত জরুরি। সেখানে মাত্র সাতটি দলকে ডেকে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। এটা ঠিক হয়নি।
গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালবেলাকে বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠকটিতে সভাপতিত্ব করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। মানে তিনি সরকারের প্রতিনিধি। ধারণা করছি, সরকার যাদের রাজনৈতিক অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং যাদের আপনজন বিবেচনা করেছে, ঘনিষ্ঠজন মনে করেছে, তাদের এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আন্দোলনের ভূমিকা বিবেচনা করে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে, এমনটি মনে হয়নি। এই বৈঠকের অবশ্যই একটা প্রচারমূল্য আছে; কিন্তু বাস্তবে এর বড় কোনো রাজনৈতিক তাৎপর্য নেই।
তিনি বলেন, বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকার গঠিত বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের প্রধানদেরও বসানো হয়েছে। আমার ধারণা, সরকারের এজেন্ডাগুলোর ব্যাপারে অর্থাৎ সংস্কার ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো যাতে একমত হন, সেজন্য দলগুলোকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে চাপে রাখার জন্য, তাদের ওপর একটা পরোক্ষ চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিবের উপস্থিতিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও সংস্কার কমিশনের সবাইকে রাখা হয়েছে।
সাইফুল হক আরও বলেন, মনে হয়, সরকার নিজেরা নিজেদের যথেষ্ট শক্তিশালী কিংবা সক্ষম মনে করছে না। সংস্কার, বিচার ও নির্বাচনের ব্যাপারে জাতিসংঘকেও তারা এখানে যুক্ত করতে চায়। আমাদের গণতান্ত্রিক উত্তরণে নিশ্চয় আমরা জাতিসংঘের সমর্থন চাই। তবে মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে এই সংস্কার এবং নির্বাচনের ব্যাপারে জাতিসংঘের আরও ভূমিকা চায় সরকার।
গণতন্ত্র মঞ্চের এই সমন্বয়ক বলেন, সংস্কারের ব্যাপারে জাতিসংঘ মহাসচিবের তো কোনোকিছু করণীয় নেই। কারণ, সংস্কারের এজেন্ডা হচ্ছে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এটা হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর বিষয়। এখানে সরকারেরও মধ্যস্থতাকারী কিংবা সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া প্রত্যক্ষ কোনো ভূমিকা নেই।
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, কীসের ভিত্তিতে মাত্র সাতটি দলকে জাতিসংঘ মহাসচিবের বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হলো, তা আমরা জানি না। আমরা দীর্ঘদিন ধরে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে ছিলাম। এই আমন্ত্রণের ক্ষেত্রে একটা বৈষম্য হয়েছে। এটা সঠিক হয়নি। এর মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কার্যত নিজেরাই বৈষম্য সৃষ্টি করছে, রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরেও বিভাজন সৃষ্টি করছে।
১২ দলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান লায়ন মো. ফারুক রহমান কালবেলাকে বলেন, স্বৈরাচারী শেখ হাসিনাকে বিদায় করতে আমরা বিএনপির নেতৃত্বে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে ৪০টির মতো রাজনৈতিক দল রাজপথে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি; কিন্তু জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠকে মাত্র সাতটি দলকে আমন্ত্রণ জানানো হলো। এর মধ্য দিয়ে সরকার কী বোঝাতে চাচ্ছে, আমরা বুঝতে পারছি না। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সবাইকে ডাকলে ভালো হতো, দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এটা দরকারও ছিল।
কোন প্রেক্ষাপটে এবং কীসের ভিত্তিতে মাত্র সাতটি দলকে নির্বাচিত করা হয়েছে, অন্য দলগুলোর হতাশা কাটাতে সরকারের সেটা প্রকাশ করা উচিত বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান। তিনি কালবেলাকে বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিব যদি কোনোভাবে লিমিট করে দিয়ে থাকেন যে, এর বাইরে হবে না-সেটা একটা কথা। আরেকটি বিষয় হলো, সবার সঙ্গে উনি কথা বলতেও পারবেন না। কোন প্রেক্ষাপটে এবং কীসের ভিত্তিতে মাত্র সাতটি দলকে নির্বাচিত করা হয়েছে, সেটা হয় জাতিসংঘ মহাসচিবের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নতুবা সরকারের সিদ্ধান্তে হতে হবে। সরকারের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে হলে সেটা তাদের প্রকাশ করতে হবে, কেন এটা সাতটি দলই, অন্যরা নয় কেন? অন্যথায় অন্য দলগুলো হতাশ হয়ে পড়বে। কারণ, তারাও তো বৈষম্যবিরোধী ও কর্তৃত্ববাদবিরোধী আন্দোলনেরও এজেন্ট।
তিনি আরও বলেন, তারা (সরকার) যদি চাইতেন আরও দলগুলোকে পর্যায়ক্রমে কিছু কিছু করে সময় দিতে পারত। সেটা না করে বিশেষ কোনো কোনো দলকে প্রাধান্য দেওয়া হলে সেটা রাষ্ট্রের জন্য ভালো নয়।
মন্তব্য করুন