মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে ওঠা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ভাসানচরের মালিকানা নিয়ে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ ও নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার বাসিন্দাদের মধ্যে বিরোধ তুঙ্গে উঠেছে। দ্বীপটিকে নিজেদের দাবি করে দুই পক্ষই মিটিং-মিছিলসহ নানা তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। এমন পরিস্থিতিতে দ্বীপটির মালিকানা নির্ধারণে গঠিত কমিটি বলছে, দ্বীপটি হাতিয়ার অংশ হবে নাকি সন্দ্বীপের সঙ্গে যুক্ত হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে ১৫ দিনের মধ্যে।
ভাসানচর নিয়ে বিরোধ কেন: বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ভাসানচরের অবস্থান সন্দ্বীপ থেকে ২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ও হাতিয়া থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে। ২০১০ সাল থেকে দ্বীপটি দৃশ্যমান হতে থাকে। সন্দ্বীপের বাসিন্দারা তখন এর নাম দেয় ঠেঙ্গারচর। পরবর্তী সময়ে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের কারণে আলোচনায় আসে দ্বীপটি। ওই বছরই জরিপের মাধ্যমে দ্বীপটি নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার বাসিন্দাদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রভাব খাটিয়ে দ্বীপটিকে হাতিয়ার সঙ্গে যুক্ত করেন। ২০২১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ ভাসানচরকে হাতিয়া ও নোয়াখালীর অংশ বলে উল্লেখ করে ‘ভাসানচর থানা’ গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করে। তখন থেকেই সন্দ্বীপের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ভাসানচরকে নিজেদের বিলীন হয়ে যাওয়া ন্যায়ামস্তি ইউনিয়ন হিসেবে দাবি করে আন্দোলন করে আসছেন। গত ৫ আগস্ট দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেই আন্দোলন নতুন করে গতি পায়।
বিরোধ মীমাংসায় কমিটি: সন্দ্বীপের মানুষের দাবির মুখে সীমানা জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় ‘চট্টগ্রাম-নোয়াখালী জেলার সীমানা জটিলতা নিরসন কমিটি’ নামে একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটিতে চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর জেলা প্রশাসকসহ সন্দ্বীপ ও হাতিয়া উপজেলা থেকে তিনজন করে পেশাজীবীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গত ৯ মার্চ চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কমিটির প্রথম সভা হয়। সভার সিদ্ধান্তের আলোকে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রাজস্ব শাখা ভাসানচরকে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার অন্তর্গত দেখিয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাদিউর রহিম জাদিদের সই করা এক চিঠিতে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম (সন্দ্বীপ) ও নোয়াখালীর (হাতিয়া) অংশে আন্তঃজেলা সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তিতে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিরোধপূর্ণ ভাসানচরটি জেগে ওঠা নতুন চর। ২০১৬-১৭ জরিপ মৌসুমে ওই চরে দিয়ারা জরিপ পরিচালনা করা হয়। ওই দিয়ারা জরিপে ভাসানচরকে ছয়টি মৌজায় ভাগ করা হয়। একই সঙ্গে ভাসানচরকে নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু সিএস ও আরএসের মৌজা ম্যাপগুলো জিআইএস প্রযুক্তির মাধ্যমে পেন্টাগ্রাফ করে দেখা গেছে, জেগে ওঠা চর চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার অন্তর্গত। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক তার চিঠিতে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে ফাইল পাঠান।
ভাসানচর কার, জানতে অপেক্ষা ১৫ দিনের: গত বৃহস্পতিবার সীমানা জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে গঠিত কমিটির দ্বিতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ভাসানচরের মালিকানা চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার না নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার, সে সিদ্ধান্ত হয়নি। কমিটি এদিন উভয়পক্ষের যুক্তি ও দাবিদাওয়া শুনেছে। সভায় চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের পক্ষে কথা বলেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সালেহ নোমান। আর নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার পক্ষে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদসহ অন্যরা যুক্তি তুলে ধরেন। উভয়পক্ষের সঙ্গে বসে তাদের কথা শুনে কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মো. নুরুল্লাহ নুরী বলেন, আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যেই বিরোধের ফয়সালা হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, এটা নিয়ে আর কোনো সভা হবে না। জেলা প্রশাসকদ্বয়ের পাঠানো প্রতিবেদন ও অন্যান্য জরিপের তথ্য পর্যালোচনা করে আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে আমাদের প্রতিবেদন দাখিল করব। এ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ভাসানচর কোন উপজেলার অন্তর্ভুক্ত হবে, সে সিদ্ধান্ত হতে পারে।
হাতিয়াবাসীর তৎপরতা থেমে নেই: এদিকে ভাসানচরের মালিকানা নিয়ে জটিলতা নিরসনে কমিটির কাজ চলমান থাকলেও হাতিয়ার লোকজন নানা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। ভাসানচরকে হাতিয়ার অংশ দাবি করে গত ৭ এপ্রিল এনসিপি নেতা আবদুল হান্নান মাসউদ ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। এরপর গত বুধবার ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবে হাতিয়া দ্বীপ সমিতির উদ্যোগে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। একই দিন চট্টগ্রামেও হাতিয়াবাসীর পক্ষ থেকে মানববন্ধন করা হয়।
মন্তব্য করুন