দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ঘোষিত স্থানীয় পর্যবেক্ষকের তালিকায় আছে আবদুল মোমেন খান মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্বে আছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খানের স্ত্রী রোকসানা খন্দকার। তালিকায় থাকা ডেমোক্রেসি ওয়াচের নির্বাহী পরিচালক বিএনপির অন্যতম নীতিনির্ধারক হিসেবে পরিচিত সাংবাদিক শফিক রেহমানের স্ত্রী তালেয়া রহমান। আবার জামালপুরের বেসরকারি সংস্থা এসডিওর সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম শরীফপুর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। ঢাকার শিশু প্রতিভা বিকাশ কেন্দ্রের সভাপতির দায়িত্বে আছেন ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মো. মিজানুর রহমান। ফরিদপুরের হাইলাইট ফাউন্ডেশনের প্রধান মো. সহিদুল ইসলাম ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন ফরিদপুর-৫ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিলেন। তালিকায় আছে জামায়াত সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সংস্থাও।
এভাবেই ইসির পর্যবেক্ষক তালিকায় জায়গা পেয়েছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের প্রতিষ্ঠান। অথচ অন্যান্য যোগ্যতা থাকলেও শুধু রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে বাদ পড়েছে বেশ কিছু সংস্থা। ইসির এমন দ্বৈত নীতির কারণে নির্বাচন পর্যবেক্ষক তালিকা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করলেও এবার বাদ পড়া কয়েকটি সংস্থা এরই মধ্যে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছে। তবে এ নিয়ে ইসি এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম কালবেলাকে বলেন, ‘কমিশনের নীতিমালা মেনেই পর্যবেক্ষকদের প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, কোনো সংস্থার সম্পর্কে অভিযোগ পাওয়া গেলে তা নিয়ে শুনানি শেষে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে। আপাতত নতুন করে কোনো সংস্থার আবেদনের সুযোগ নেই। কমিশন মনে করলে আবার পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নতুন আবেদন আহ্বান করতে পারে। এ ছাড়া কোনো সংস্থার বিষয়ে ফের বিবেচনার বিষয়টিও কমিশনের এখতিয়ার।’ইসির পর্যবেক্ষক নীতিমালায় বলা আছে, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন বা আছেন কিংবা নিবন্ধনের জন্য আবেদন করার সময়ের মধ্যে কোনো নির্বাচনের প্রার্থী হতে আগ্রহী কোনো ব্যক্তি যদি আবেদনকারী কোনো সংস্থার প্রধান নির্বাহী কিংবা পরিচালনা পর্ষদের বা ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য পদে থাকেন, তাহলে ওই সংস্থাকে নিবন্ধন দেওয়া হবে না। তবে ইসি যে ৬৮টি সংস্থার তালিকা প্রকাশ করেছে, সেখানে অন্তত দেড় ডজন সংস্থার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়—এসব সংস্থার মধ্যে ভুঁইফোঁড় এমন অনেক সংস্থা রয়েছে, যাদের মাঠপর্যায়ে কোনো কার্যালয় বা লোকবলও নেই, যা নিয়ে এরই মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। যদিও নির্বাচন কমিশন বলছে, ইসির নীতিমালা মেনেই সংস্থাগুলোকে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত করা হয়েছে। তবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোনো সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে সেটি শুনানির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হবে। এসব প্রক্রিয়া শেষে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কোনো পর্যবেক্ষক সংস্থার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই জমা পড়েনি। ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম (ইএমএফ) ও সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনসহ কয়েকটি সংস্থা ইসির সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য সচিব বরাবর আবেদন করেছে। তাদের ব্যাপারেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
এর আগে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনসহ আগামী পাঁচ বছরের জন্য পর্যবেক্ষক তালিকা করতে আবেদন আহ্বান করে নির্বাচন কমিশন। এতে দুই শতাধিক আবেদন জমা পড়ে। যাচাই-বাছাই করে সেখান থেকে ৯৪টি সংস্থাকে তালিকায় রাখে কমিশন। সেখান থেকে ৬৮টি সংস্থাকে রেখে গত ১১ আগস্ট গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে ইসি। নিয়ম অনুযায়ী এ সময় তালিকা প্রকাশের ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে কোনো সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তা ইসিতে জমা দিতে বলা হয়। এরপর সেসব অভিযোগ শুনানি শেষে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করবে কমিশন।
গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ৬৮টি পর্যবেক্ষক সংস্থার তালিকা প্রকাশের পরই এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। কারণ, এতে এমন অনেক সংস্থা রয়েছে—যাদের বাস্তবে কোনো কার্যক্রম নেই। নামসর্বস্ব এসব সংস্থার নেই তেমন কোনো জনবলও। এ ছাড়া এ তালিকায় অন্তত দেড় ডজন সংস্থার পরিচালনা পর্ষদে থাকা ব্যক্তি বা তাদের নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে, যা পর্যবেক্ষক নীতিমালার সম্পূর্ণ বিরোধী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইসি প্রকাশিত গণবিজ্ঞপ্তির পর্যবেক্ষক তালিকায় এক নম্বরে থাকা ঢাকার মানবাধিকার ও সমাজ উন্নয়ন সংস্থার (মওসুস) প্রধান ড. মো. গোলাম রহমান ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে জামায়াত সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। সরাসরি দলের কোনো পদে না থাকলেও তিনি জামায়াতপন্থি আইনজীবী হিসেবে পরিচিত। ফরিদপুরের হাইলাইট ফাউন্ডেশনের প্রধান মো. সহিদুল ইসলাম ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করেন। তার ভাই মো. শরিফুজ্জামান ভাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। রাজশাহীর স্বাস্থ্য শিক্ষা সেবা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আর কে দত্ত রূপন রাজশাহী মহানগর তাঁতী লীগের সহসভাপতি। ফরিদপুরের এসো জাতি গড়ি নামে সংস্থার নির্বাহী পরিচালক নাজমা আক্তারের বাবা প্রয়াত নেজায়েতুল্লা বিএনপির নেতা ছিলেন। তার ভাই মো. আহসানউল্লাহ ছাত্রদলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আবার তার বোন নাজনীন আক্তার বর্তমানে ফরিদপুর পৌরসভার সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর এবং জেলা কৃষক লীগের যুগ্ম সম্পাদক। যশোরের বাঁচতে শেখা সংস্থার পরিচালনা পর্ষদের কোষাধ্যক্ষ মো. শাহজাহানের ভাই নাসির উদ্দীন যশোর-২ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। দিনাজপুরের সংস্থা বেসিকের নির্বাহী পরিচালক শ্যামল চন্দ্র সরকার কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ছাত্রমৈত্রীর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
আবার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে একই ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন এক সংস্থাকে বাদ দেওয়া হলেও তার আরেক সংস্থাকে তালিকায় রাখা হয়েছে।
ইসি সূত্র জানায়, ইলেকশন মনিটরিং ফোরামের পরিচালক সুলতানা রাজিয়া মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সেই অভিযোগে এই সংস্থাকে এবার পর্যবেক্ষক তালিকায় রাখেনি ইসি। রাজিয়া সুলতানা লুৎফর রহমান ভূঁইয়া (এলআরবি) ফাউন্ডেশন নামে আরেকটি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক। ইসির পর্যবেক্ষক তালিকার ১৪ নম্বরে আছে এলআরবির নাম।
ইলেকশন মনিটরিং ফোরামের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবেদ আলী কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের সংস্থাটি ৫০টি সংগঠনের একটি মোর্চা। আমরা ইসির যথাযথ শর্ত ও নিয়ম মেনেই নির্বাচন পর্যবেক্ষণের আবেদন করি। আবেদনের পর জানতে পারি আমাদের সংস্থার এক পরিচালক ক্ষমতাসীন দলের একটি সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা। পরে আমরা তাকে পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে ইসিকে লিখিতভাবে অবহিত করি; কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইসির পর্যবেক্ষক তালিকা দেখে আমরা অবাক হইনি, বিব্রতও হয়েছি। কারণ, এর আগেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও আমরা পর্যবেক্ষক করেছি।’
সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য ইসি সচিব বরাবর আবেদন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি আমাদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। কারণ, ইসির পর্যবেক্ষক তালিকায় থাকা অনেক সংস্থার বিরুদ্ধেই রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার প্রমাণ রয়েছে। রাজনৈতিক কারণে বাদ দিতে হলে তাদেরও বাদ দেওয়া উচিত ছিল। আমরা আশা করি, কমিশন আমাদের আবেদনটি ইতিবাচক হিসেবে এবং নিরপেক্ষভাবে দেখে ন্যায়বিচার করবে।’
সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকেও ইসিতে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করা হয়েছে বলে জানান সংস্থাটির মহাসচিব।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার কালবেলাকে বলেন, ‘যেসব সংস্থার পরিচালনা পর্ষদে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তি কিংবা তাদের নিকটাত্মীয় বা ঘনিষ্ঠজনরা আছেন, সেসব সংস্থাকে নিবন্ধন দেওয়ায় আক্ষরিকভাবে নীতিমালা ভঙ্গ না হলেও এটি নৈতিকতার বিষয়। আগামী নির্বাচনের জন্য ইসি যে তালিকা প্রকাশ করেছে, সেখানে অনেক ভুঁইফোঁড় সংগঠনও আছে। এ নিয়ে নানা বিতর্ক দেখা দিয়েছে। সুযোগ থাকলে সেগুলো পুনর্বিবেচনা করা উচিত।’
মন্তব্য করুন