ডেঙ্গু পরিস্থিতি বিবেচনায় ভয়ংকর একটা মাস শেষ হলো দেশে। গত আগস্টে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্রায় সাড়ে ৩০০ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এক মাসের হিসাবে এত মৃত্যু আর কখনো দেখেনি বাংলাদেশ। এমনকি এক বছরেরও এত মৃত্যুর রেকর্ড নেই। দুই দশকের মধ্যে ২০২২ সালে সর্বোচ্চ ২৮১ জনের মৃত্যু হয় প্রাণঘাতী এই রোগে। আজ শুক্রবার শুরু হলো নতুন মাস সেপ্টেম্বর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এ মাসেও ডেঙ্গু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা খুব একটা নেই।
গত বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত সক্রিয় ছিল ডেঙ্গুর প্রকোপ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ বছরও বিলম্বে বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ কোথায় গিয়ে থামবে, জানে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জনস্বাস্থ্যবিদরা জানিয়েছেন, এ বছরও ডিসেম্বর পর্যন্ত থাকতে পারে ডেঙ্গু সংক্রমণ। এ জন্য এখনই ডেথ রিভিউ শুরু করে জানতে হবে, মৃত্যুর প্রকৃত কারণ। তাহলে চিকিৎসাসেবায়ও পরিবর্তন করা সম্ভব হবে। মানুষের প্রাণও বাঁচবে।
গত ৩০ আগস্ট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ৬৪ শতাংশ শক সিনড্রোম। এতে মূলত পালস ও রক্তচাপ কমে যায়। এ জটিলতা দেখা দিলে শরীরে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রক্ত চলাচল কমে যায়, বিভিন্ন অঙ্গের কোষে যে অক্সিজেন দরকার সেই অক্সিজেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে রোগীর মৃত্যুও বেশি হয়। চলতি মৌসুমের শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৫৯৩ জনের মৃত্যু হয়। তার মধ্যে ৬৪ শতাংশ শক সিনড্রোম, ২৩ শতাংশ এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম, ৯ শতাংশ হেমোরেজিক ফিভারে এবং ৪ শতাংশ কোমরবিডিটি ডেঙ্গু আক্রান্ত ছিল। ঢাকা সিটির বাইরে ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে। ঢাকার বাইরে ৭৩ শতাংশ মৃত্যুই হয়েছে ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে। অন্যদিকে ঢাকায় শক সিনড্রোমে মৃত্যু হয়েছে ৬৩ শতাংশের। এ বছর মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, অতীতের চেয়ে এবার মৃত্যুহার বেশি। কেন বেশি মৃত্যু হচ্ছে, সেটা জানা যাবে ডেথ রিভিউ করলে। বিশ্বের প্রতিটি দেশে প্যান্ডেমিক চলাকালে ডেথ রিভিউ হয়। রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) ডেথ রিভিউ এখনই শুরু করা দরকার। ডেথ রিভিউ করলে জানতে পারব চিকিৎসার কোথায় ঘাটতি আছে। জনগণকেও সঠিক তথ্য জানাতে পারব। কোন কোন প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এডিসের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করা সম্ভব হবে, সেটাও জানা যাবে। এ কাজের জন্য প্রয়োজনে আইইডিসিআরের লোকবল বাড়াতে হবে। তবুও দ্রুত ডেথ রিভিউ শুরু করতে হবে।
ডেঙ্গুবিষয়ক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গতকাল আরও ১৭ জনের মৃত্যু হয়। তার মধ্যে রাজধানীর বাসিন্দা ১৬ আর ঢাকার বাইরের আরও একজন। একই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত ২৩০৮ জনের মধ্যে ৮৭৫ জন রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভর্তি। আর ১৪৩৩ জন ঢাকার বাইরে হাসপাতালে ভর্তি। চলতি মৌসুমের শুরু থেকে গতকাল ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে ১ লাখ ২৩ হাজার ৮০৮ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে রাজধানীর বাসিন্দা ৫৮ হাজার ২১ আর ঢাকার বাইরের ৬৫ হাজার ৭৮৭ জন।
মাসের হিসাবে দেখা গেছে, গত মাসের ৩১ দিনে ৭১ হাজার ৯৭৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। মৃত্যু হয় ৩৪২ জনের। জুলাই মাসে ৪৩ হাজার ৮৫৪ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। মৃত্যু হয় ২০৪ জনের। জুনে ৫৯৫৬ জন আক্রান্ত; মৃত্যু ৩৪ জনের। মে মাসে ১০৩৬ জন আক্রান্ত, মৃত্যু দুজনের। এপ্রিলে ১৪৩ জন আক্রান্ত, মৃত্যু দুজনের। মার্চে ১১১ জন আক্রান্ত, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন আক্রান্ত, মৃত্যু হয় তিনজনের। জানুয়ারিতে ৫৬৬ জন আক্রান্তের মধ্যে মারা যান ৬ জন।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ কালবেলাকে বলেন, এদেশে ডেঙ্গু সংক্রমণের ২২ বছরের অভিজ্ঞতা। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা নিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা। অথচ বছরের পর বছর আক্রান্ত আর মৃত্যুর রেকর্ড করে যাচ্ছি। সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমবে সুনির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন। এখনো বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ডেঙ্গু কমবে কি না, সেটা নির্ভর করে এডিস মশার প্রজনন হার কেমন, প্রজননস্থল ধ্বংসে কতটা কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে; আর মানুষের শরীরে কতটা প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠেছে এসবের ওপর। গত বছরের অভিজ্ঞতা ডেঙ্গু ডিসেম্বর পর্যন্ত সম্প্রসারণ হয়েছিল।
মন্তব্য করুন