আগামী জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্র করে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে বাংলাদেশ মুক্তি ঐক্যদল। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দলটির কেন্দ্রীয় সভাপতি মো. নুর ইসলাম শিকদার। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিকানা জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার একটি সুপার মার্কেটের দোতলায় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছিল। ঝড়ের কারণে দলের সাইনবোর্ড উড়ে গেছে। নতুন করে সাইনবোর্ড বানাতে দিয়েছি। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে নতুন কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রস্তুত করবেন বলে জানান নুর ইসলাম। আরেক আবেদনকারী বাংলাদেশ বেকার মুক্তি পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি আতিকুর রহমান রাজা বলেন, বাংলাদেশকে বেকারমুক্ত করতে এই রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেছি। এবারই প্রথম নিবন্ধনের আবেদন করা হয়েছে। তিনি জানান, বর্তমানে সারা দেশে তার দলের আটটি জেলা ও ৭২টি উপজেলায় কমিটি রয়েছে। বাংলাদেশের জাস্টিস পার্টি (বাজাপা) চেয়ারম্যান সৈয়দ জাভেদ মো. সালেহউদ্দিন বলেন, আগে দুবার নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা হলেও নিবন্ধন দেওয়া হয়নি। আমাদের ৮ থেকে ১০টি উপজেলায় দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি রয়েছে। তবে সেটি কোন কোন জেলায়, তা তিনি জানেন না।
নির্বাচন সামনে রেখে এভাবে তৎপর হয়ে উঠেছে বাহারি নামসর্বস্ব এরকম অনেক রাজনৈতিক দল।
এসব দলের কোনোটির নেই কার্যকরী কমিটি; কোনোটি আছে শুধুই কাগজ-কলমে। আবার কোনোটি দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় তো দূরের কথা, সাইনবোর্ড পর্যন্ত নেই।
গতকাল রোববার ছিল নিবন্ধন আবেদনের শেষ দিন। শেষ দিনে আবেদনের হিড়িক পড়ে ইসিতে। শুধু গতকালই অন্তত তিন ডজন রাজনৈতিক দল আবেদন করে। আর শেষ দিন পর্যন্ত নিবন্ধনের জন্য মোট আবেদন করেছে ১৪৭টি রাজনৈতিক দল। নিবন্ধনপ্রত্যাশী দলের চেয়ারম্যান, মহাসচিবও যেমন সশরীরে আবেদন জমা দিতে এসেছেন, তেমনি দলীয় নেতাকর্মীদের ঘোড়ার গাড়িতেও চড়ে আসতে দেখা যায়। আবেদন জমা দিয়ে কেউ কেউ সাংবাদিকদের কাছে নিজেদের প্রতীক ও দলের নাম যেমন তুলে ধরতে চান, তেমনি অনেকে চুপচাপ আবেদন জমা দিয়ে চলে যান। দলগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটির রয়েছে বাহারি নামও। সবার দাবি, নির্বাচন কমিশন-ইসির সব শর্ত পূরণ করেই নিবন্ধন আবেদন করা হচ্ছে। তাদের দল নিবন্ধন পাবেই।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, জনতার পার্টি বাংলাদেশ (জেপিপি); গণদল, বাংলাদেশ জনজোট পার্টি (বাজপা); বাংলাদেশ রিপাবলিক পার্টি (বিআরপি), বাংলাদেশ ফরায়েজী আন্দোলন; বাংলাদেশ সিটিজেন পার্টি; ইসলামী ঐক্যজোট; নতুন বাংলাদেশ পার্টি (এনবিপি); বাংলাদেশ জাগ্রত জনতা পার্টি; বাংলাদেশ গণবিপ্লবী পার্টি; ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী ন্যাপ); বাংলাদেশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ফেডারেশন; জনতার দল; বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা জনতা পার্টি; বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এম এল); বাংলাদেশ নাগরিক পার্টি (বিসিপি); জাতীয় ন্যায়বিচার পার্টি; বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিডিপি), ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি), আ আমজনগণ পার্টির মতো রাজনৈতিক দল ইসিতে নিবন্ধন আবেদন করেছে।
এ ছাড়া নিউক্লিয়াস পার্টি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টি, বাংলাদেশ শান্তির দল, দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও আন্দোলন, জাতীয় ভূমিহীন পার্টি, বাংলাদেশ বেকার সমাজ, বাংলাদেশ জনপ্রিয় পার্টি, জনতার কথা বলে, সমতা পার্টি—এ ধরনের বাহারি নামের অনেক দল রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের আবেদন করেছে।
ওয়ার্ল্ড মুসলিম কমিউনিটি নামে দলের নিবন্ধন চেয়ে ইসির কাছে আবেদন করেছেন মাওলানা মাহমুদ আব্বাস, ‘সমতা পার্টি’র নিবন্ধনে হানিফ বাংলাদেশি, ‘বাংলাদেশ জাতীয় ভূমিহীন আন্দোলন’-এর নামে আলাল হোসেন খন্দকার, ‘বাংলাদেশ বৈষম্যবিরোধী গণতান্ত্রিক দল’-এর আবেদনে লায়ন নূর ইসলাম, ‘ন্যাশনাল কংগ্রেস বাংলাদেশ (এনসিবি)’-এর ছাবের আহাম্মদ (কাজী ছাব্বীর), ‘বাংলাদেশ মুসলিম পার্টি’র নামে মুহাম্মদ মুজ্জামেল হক, ‘তৃণমূল জাতীয় পার্টি’র এ এ এম শামীম, ‘বাংলাদেশ রিপাবলিকান পার্টি’র কে এম আবু হানিফ হৃদয়, ‘সর্বজন বিপ্লবী দল’-এর প্রকৌশলী ইনামুল হক এবং ‘মৌলিক বাংলা’ নামে নিবন্ধনের আবেদন করেছেন ছাদেক আহমেদ (সজীব)।
গতকাল শেষ দিনে আবেদন করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটি শাপলাসহ তিনটি প্রতীক চেয়ে আবেদন করে। পছন্দের প্রতীকের তালিকায় শাপলা ছাড়াও কলম ও মোবাইল রেখেছে দলটি।
গতকাল রোববার বিকেলে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) আবেদন জমা দেয় নতুন রাজনৈতিক দলটি। এ সময় এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, মুখ্য সমন্বয়ক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন উপস্থিত ছিলেন।
ýনির্বাচন ভবনে আবেদন জমা দিয়ে জনতার পার্টি বাংলাদেশ (জেপিপি) মহাসচিব শওকত মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছি। নিবন্ধন বিধিমালার যে শর্ত আছে সেগুলো পালন করা খুব কষ্টকর। নির্বাচন কমিশন কিছু কিছু বিধিমালা সংস্কারের প্রস্তাব রেখেছে। এ প্রস্তাবগুলো কিন্তু এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। তার পরও পুরোনো বিধিমালা অনুযায়ী আমরা আবেদন জমা দিয়েছি এবং আমরা আশা করি আমরা রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পাবো।’
তিনি বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলো বিবেচনায় নিয়ে যদি বিধিমালা সংস্কার করা হয় সেই সংস্কারেও নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করতে চান এবং দলটি হাতি প্রতীক চেয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের লক্ষ্যে গঠিত বাংলাদেশ রিপাবলিক পার্টি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লেফটেন্যান্ট সাইফুল্লাহ খান সাইফের (অব.) নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল আবেদনপত্র জমা দেন। ইসির সব শর্ত মেনে আবেদন করা হয়েছে জানিয়ে নেতারা এ সময় নিবন্ধনের ব্যাপারে বেশ আশাবাদী বলে জানান।
চাবি প্রতীকে নিবন্ধন চেয়ে আবেদন করেন জনতার দলের আহ্বায়ক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম কামাল ও সদস্য সচিব আজম খান। আবেদন জমা দেওয়ার পর শামীম কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘নিবন্ধনের সব শর্ত পূরণ করে আমরা আবেদন করেছি। আমাদের জেলা ও উপজেলা কমিটি আইন অনুযায়ী গঠন করা হয়েছে। এখন বাকি সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন।’
এবারের নির্বাচন সামনে রেখে গত ১০ মার্চ আগ্রহী দলগুলোর কাছ থেকে নিবন্ধন আবেদন আহ্বান করা হয়। নির্ধারিত সময় ২০ এপ্রিলের মধ্যে আবেদন করে ৬৫টি নতুন রাজনৈতিক দল। তবে জুলাই অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা তরুণদের রাজনৈতিক দল এনসিপিসহ ৪৬টি দলের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নিবন্ধন আবেদনের সময়সীমা দুমাস বাড়িয়ে ২২ জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। বর্ধিত সেই সময় গতকাল শেষ হয়েছে।
এর আগে গত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ইসির কাছে আবেদন করেও নিবন্ধন পায়নি ৮৭টি দল। তারাও তাদের আবেদন পুনর্মূল্যায়নের জন্য ইসিকে অনুরোধ জানিয়েছে। এ পর্যন্ত ৫৫টি রাজনৈতিক দল ইসির নিবন্ধন পেয়েছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে জামায়াতে ইসলামী, ফ্রিডম পার্টি, ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন, পিডিপি ও জাগপার নিবন্ধন বাতিল করা হয়। ফলে বর্তমানে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৫০টি। উচ্চ আদালতের রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন প্রক্রিয়াধীন।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত ৯ মাসে আত্মপ্রকাশ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) নতুন ২৪টি রাজনৈতিক দল। এ সময়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ইসি থেকে নিবন্ধন পেয়েছে ৬টি দল। এগুলোর মধ্যে রয়েছে—এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ (জিওপি), নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন ও বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি (বিএমজিপি)।
ইসি সূত্র জানায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে হলে নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধিত হতে হয়। এ নিবন্ধন পেতে কিছু শর্ত পূরণ করার বিধান আছে। গত বছর ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন এসব শর্ত কিছুটা সহজ করার সুপারিশ করেছে। তবে সে সুপারিশ এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি। আগের শর্তেই নিবন্ধন দিতে যাচ্ছে সংস্থাটি।
বর্তমান আইন অনুযায়ী, নিবন্ধনের জন্য দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়, অন্তত এক-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর অফিস, অন্তত ১০০টি উপজেলা বা মেট্রোপলিটন (মহানগর) থানায় কার্যালয় এবং প্রতিটি কার্যালয়ে ন্যূনতম ২০০ ভোটার তালিকাভুক্ত থাকতে হবে। স্বাধীনতার পর দলের কেউ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও শর্ত শিথিল থাকবে। এর বাইরে নিবন্ধনের জন্য দলের গঠনতন্ত্রে সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে বিধান রয়েছে। যেমন কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব কমিটির সদস্য নির্বাচিত করা, সব পর্যায়ের কমিটিতে অন্তত ৩৩ শতাংশ সদস্যপদ নারীদের জন্য নির্ধারিত রাখা এবং পর্যায়ক্রমে ২০৩০ সালের মধ্যে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী বা শ্রমিক ও অন্য কোনো পেশার সদস্যদের সমন্বয়ে অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন না থাকা ইত্যাদি।
দলগুলোর নিবন্ধন সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, নতুন দলগুলোকে নিবন্ধন দিতে আমাদের একটা যাচাই-বাছাই তালিকা রয়েছে। নিবন্ধনের আগে আমরা দেখব, নতুন আবেদনকারী দলগুলো তাদের শর্ত পূরণ করেছে কি না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুজনের সম্পাদক ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার কালবেলাকে বলেন, নাম ফোটানো, ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা বা নিজেদের আলোচনায় আসার জন্য রাজনৈতিক দল গঠন করলে তা ইতিবাচক হবে না। দল গঠন করলে দেশ ও জনকল্যাণে কাজ করতে হবে। নির্বাচন সামনে রেখে বড় বড় রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে সমঝোতা বা আসন ভাগাভাগির জন্যও এসব হতে পারে।
মন্তব্য করুন
আর্কাইভ 
| ২৩ জুন ২০২৫ 
