সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে আগামী জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে দেশের মানুষ রায় দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন চরমোনাই পীর ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম। গতকাল শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী আন্দোলন আয়োজিত মহাসমাবেশে এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, সংসদের উভয় কক্ষেই পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।
নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার দাবি করে তিনি আরও বলেন, যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সংসদে তাদের তত আসন থাকতে হবে। এটি জনগণের, জেনজি প্রজন্মের এবং সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের যৌক্তিক দাবি। প্রয়োজনে গণভোটের মাধ্যমে জনগণের রায় নিতে হবে।
ইসলামপন্থিদের ভোট এক বাক্সে রাখার আহ্বান জানিয়ে অন্যান্য ইসলামী দলের প্রতি চরমোনাই পীর বলেন, আমরা বারবার রক্ত দিয়েছি, কিন্তু সফলতা পাইনি। কারণ, আমরা প্রতিবারই নেতা ও নীতি বাছাইয়ে ভুল করেছি। ৫৪ বছরে অনেক দলকে দেশ শাসন করতে দেখেছি। কিন্তু ইসলামকে এখনো ক্ষমতায় নিতে পারিনি। এবার ইসলামপন্থিদের ঐক্য নিয়ে গণপ্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। শুরু থেকেই ইসলামপন্থি সব ভোট এক বাক্সে আনার কথা বলে আসছি। আগামী নির্বাচনে শুধু ইসলামী দলই নয়; বরং দেশপ্রেমিক আরও অনেক রাজনৈতিক দলও এক বাক্স নীতিতে আসতে পারে ইনশাআল্লাহ। আমরা একত্রে নির্বাচন করতে ও কার্যকর ঐক্য গড়ে তুলতে পারলে বাংলাদেশে ইসলামপন্থিরাই হবে প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব আমাদের হাতেই আসবে ইনশাআল্লাহ।
সংস্কার, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে এবং দেশ ও ইসলামবিরোধী সব ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের প্রতিবাদে গতকালের এ মহাসমাবেশের আয়োজন করে ইসলামী আন্দোলন। দুপুর ২টায় সমাবেশ শুরুর কথা থাকলেও সকাল থেকেই সমাবেশস্থলে আসতে থাকেন সারা দেশের নেতাকর্মীরা। উদ্যানের ভেতরে বিশালাকৃতির মঞ্চে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। সকাল ১০টায় কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হওয়া প্রথম পর্বে সারা দেশ থেকে আগত জেলা-মহানগর নেতৃবৃন্দ বক্তব্য দেন। এর মধ্যে কয়েক দফা বৃষ্টি হলেও সমাবেশস্থল ধীরে ধীরে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছাপিয়ে জনস্রোত ছড়িয়ে পড়ে শাহবাগ থেকে পল্টন মোড় ও কাকরাইল মসজিদ, দোয়েল চত্বর পর্যন্ত। সমাবেশে আগত নেতাকর্মীদের কাছে ছিল বিভিন্ন রঙের পাখা এবং গেঞ্জি ও ব্যান্ড। সমাবেশের কারণে যানবাহন ও মানুষের চাপ বাড়ায় গতকাল রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে দিনভর ছিল তীব্র যানজট।
ইসলামী আন্দোলনের ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক শাহ ইফতেখার তারিক ও সহ-প্রচার সম্পাদক মাওলানা কে এম শরীয়াতুল্লাহর পরিচালনায় সমাবেশে বক্তব্য দেন হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক, বোধিজ্ঞান ভাবনাকেন্দ্রের সভাপতি দয়াল কুমার বড়ুয়া, বাংলাদেশ খ্রিষ্টান অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি নির্মল রোজারিও, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি রফিকুল ইসলাম খান, নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মাওলানা মূসা বিন ইজহার, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন রাজি, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নূরুল হক নূর, এনসিপির সদস্য সচিব মুহাম্মদ আখতার হোসাইন, উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালাল উদ্দীন, খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউসুফ সাদিক হক্কানি প্রমুখ। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের মধ্যে বক্তব্য দেন সিনিয়র নায়েবে আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম, মাওলানা মোসাদ্দেক বিল্লাহ মাদানী, মুহাদ্দিস আব্দুল হক আজাদ, মহাসচিব মাওলানা ইউনুস আহমদ, যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান, ইঞ্জিনিয়ার আশরাফুল আলম, শেখ ফজলে বারী মাসউদ, মাওলানা মুহাম্মদ ইমতিয়াজ আলম, এছহাক মুহাম্মদ আবুল খায়ের, আহমদ আবদুল কাইয়ূম ও কে এম আতিকুর রহমান।
সভাপতির বক্তব্যে চরমোনাই পীর বলেন, পতিত ফ্যাসিস্ট জুলুমের রাষ্ট্র তৈরি করেছিল। হাজার হাজার মানুষকে গুম ও খুন করেছে। বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা দেশ থেকে চুরি করে নিয়ে গেছে। চব্বিশের জুলাইয়ে তো প্রকাশ্যে গণহত্যা করেছে। ফলে তাদের কোনো ক্ষমা নেই। যারা সরাসরি ফৌজদারি অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের বিচার করতে হবে। অপরাধের সহায়তাকারীদেরও বিচার করতে হবে। বিচারের ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হলেও পতিত সরকারের অধিকাংশ মন্ত্রী-এমপি এবং নেতারা এখনো জেলের বাইরে। অনেকেই দেশের বাইরে থেকে উসকানি দিয়ে যাচ্ছে।
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ইসলামী আন্দোলনের এই শীর্ষ নেতা বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, রাজনৈতিক চরিত্র, চাঁদাবাজির কোনো পরিবর্তন হয়নি। একটি দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে। কারও নাম ধরে সমালোচনা করতে চাই না। তবে পুরোনো রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি জিইয়ে রাখার চেষ্টা সহ্য করা হবে না। রাজনীতির নামে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজিকে অবশ্যই প্রতিহত করা হবে, ইনশাআল্লাহ।
রেজাউল করীম তার বক্তব্যে কৃষক-শ্রমিক, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, আইনশৃঙ্খলা ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর স্বার্থ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেন এবং ব্যবসাবান্ধব বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেন। প্রবাসীদের ভিআইপি দাবি করে তাদের উপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা নিশ্চিতে করণীয় সবকিছু করার অঙ্গীকার করেন। উলামায়ে কেরামের মর্যাদা ও সম্মান প্রতিষ্ঠা, নারীর অধিকার, সম্মান এবং সংখ্যালঘুদের জন্য নিরাপদ বাংলাদেশ নির্মাণে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের অঙ্গীকার তুলে ধরেন।
পিআর পদ্ধতির নির্বাচন নিয়ে বিএনপির আপত্তির বিষয়ে ইসলামী আন্দোলনের আমির বলেন, আমরা পিআর পদ্ধতির নির্বাচন চাই। কিন্তু বিএনপি মানছে না কেন? তারা জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলছেন। তবে জাতীয় সরকার করতে হলে তো পিআর পদ্ধতির নির্বাচনই দরকার। সেটি বিএনপিকে মানা উচিত। বিএনপি ক্ষমতায় যাবে, এই গ্যারান্টি কে দিয়েছে? অতীতে ক্ষমতায় না আসতে পারার কারণ তো দেশবাসী জানে। আগামীতে ক্ষমতায় কে যাবে জানি না। তবে জনগণ দখলবাজ, চাঁদাবাজ ও খুনিদের আর ক্ষমতায় যেতে দেবে না। একটি বাক্স নির্বাচনের জন্য ইসলামের প্রার্থী দিতে চাই। ইসলাম ক্ষমতায় এলে দেশে গুম-খুন, অর্থ লুট ও গণতন্ত্র ধ্বংস হবে না।
সমাবেশে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান বলেন, ইসলামী আন্দোলনের হাতপাখা ও জামায়াতের দাঁড়িপাল্লা এক জায়গায় করতে পেরে চরমোনাই পীর বীর হয়ে গেছেন। আগামীতে আরও সমাবেশ হবে এবং সমাবেশে আরও মানুষ হবে। কোরআনের আইনের পক্ষে মানুষের জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। আগের মতো নির্বাচন জনগণ মানবে না।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, আজকে ঐক্যের জোয়ার শুরু হয়েছে। দ্বীনকে সংসদে নেওয়ার জন্য ভেদাভেদ ভুলে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকব।
মহাসমাবেশে ইসলামী আন্দোলনের মুখপাত্র মাওলানা আতাউর রহমান ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হবে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতি—এ বিষয়টি সংবিধানে অবশ্যই পুনঃস্থাপন, পিআর পদ্ধতিতে সংসদ নির্বাচন, ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই মাসেই জুলাই সনদ ঘোষণা, রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার দ্রুত সম্পন্ন, নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড গড়ে তোলা, ফ্যাসিস্ট সরকারের বিচার নিশ্চিত করাসহ ১৬টি দাবি তুলে ধরা হয় ঘোষণাপত্রে।
মন্তব্য করুন