তিন দফায় দরকষাকষি শেষে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যা আগামী ৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হচ্ছে। শুক্রবার ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে এ তথ্য জানানো হয়। এতে একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারনির্ভর দেশের রপ্তানি খাতের যেমন স্বস্তি এসেছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ঘিরে তৈরি হয়েছে নতুন সম্ভাবনাও। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলের তৃতীয় ধাপের আলোচনার পর যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক কমানোর ঘোষণা আসে। প্রধান উপদেষ্টা শুল্ক কমিয়ে আনা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছানোকে ঐতিহাসিক ও কূটনৈতিক সাফল্য বলে উল্লেখ করেছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে করা চুক্তিতে কী ধরনের শর্ত রয়েছে, তা এখনো জানা যায়নি। যদিও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানিয়েছেন, বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্র আলাদা করে কোনো শর্ত আরোপ করেনি, বাকি দেশগুলোর মতো একই শর্ত দিয়েছে।
গত ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল বাণিজ্য ঘাটতির জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিশ্বের অনেক দেশকে দায়ী করেন। এর পরই ঘোষিত হয় পাল্টা শুল্ক বা রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ—যার আওতায় বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক বসে। ৯ এপ্রিল আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে সেই শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত রাখে ওয়াশিংটন। পরে ৮ জুলাই ট্রাম্প অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়ে জানান—বাংলাদেশের জন্য পাল্টা শুল্ক ৩৫ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়েছে, যা ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। সে অনুযায়ী ৩১ জুলাইয়ের চূড়ান্ত সময়সীমার আগে ওয়াশিংটনের সঙ্গে একটি সমন্বিত বাণিজ্য চুক্তিতে পৌঁছাতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। এই চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে বাংলাদেশের ওপর শুল্ক ২০ শতাংশ নির্ধারণ করে। তবে এটি গড় ১৫ শতাংশ বিদ্যমান শুল্কের সঙ্গে মিলিয়ে কার্যকরভাবে দাঁড়াবে ৩৫ শতাংশে। এত আলোচনা ও অর্জনের মধ্যেও যে প্রশ্নটি স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে, তা হলো—যুক্তরাষ্ট্র থেকে এ শুল্ক ছাড়ের বিনিময়ে বাংলাদেশ কী কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেই তথ্য এখনো পুরোপুরি প্রকাশ করা হয়নি। এরই মধ্যে গম, তুলা ও বিমান আমদানির বিষয়টি সামনে এলেও অনেক কিছু অজানা রয়ে গেছে বলেও দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে এক প্রতিক্রিয়ায় ইউএসটিআরের সঙ্গে তৃতীয় দফার আলোচনায় থাকা বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমরা সতর্কতার সঙ্গে আলোচনা করেছি, যাতে প্রতিশ্রুতিগুলো আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। পোশাক শিল্পকে রক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। তবে পাশাপাশি কিছু প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছে—বিশেষত মার্কিন কৃষিপণ্য আমদানি নিয়ে। গম, তুলা এমনকি বিমান আমদানির বিষয়েও আমরা ইতিবাচক ইঙ্গিত দিয়েছি। এটি শুধু আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য নয়, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপ্রধান রাজ্যগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক উন্নয়নেও সহায়ক।’
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রাপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ হলো ভিয়েতনাম। স্বস্তির বিষয় হচ্ছে ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশের ওপর একই হারে শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, ২০ শতাংশ। তবে ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ১২৩ বিলিয়ন ডলারের। এই বিশাল ঘাটতির জবাবে ট্রাম্প প্রশাসন ভিয়েতনামের পণ্যে প্রথমে ৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা জানালে দেশটির সঙ্গে আলোচনা শুরু করে হ্যানয়। আলোচনার টেবিলে ভিয়েতনাম প্রস্তাব দেয়, তারা নিয়মিত বাণিজ্যের বাইরে অতিরিক্ত ১০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে—অর্থাৎ মোট ঘাটতির মাত্র ১০ বিলিয়ন ডলার কমাবে। এতেই যুক্তরাষ্ট্র ইতিবাচক সাড়া দেয়; শুল্কহার ৪৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে প্রথমে ২৫ শতাংশ এবং দ্বিতীয় দফায় তা আরও কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক গড় বাণিজ্যপ্রবাহ মাত্র ৮ বিলিয়ন ডলার, ঘাটতি গড়ে ৬ বিলিয়ন ডলার এবং আমদানি গড়ে ২ বিলিয়ন ডলারের। এই তুলনামূলক ছোট ঘাটতির বিপরীতে বাংলাদেশ আরও ৩ বিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত ঘাটতি হ্রাসের প্রতিশ্রুতি দেওয়াতে আলোচনা থেকে শুল্ক কমেছে মাত্র ১৫ শতাংশ। এ নিয়ে অখুশি না হলেও পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন মার্কিন বাণিজ্য দপ্তরের (ইএসটিআর) প্রতিনিধিদলের সঙ্গে দরকষাকষিতে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে থাকা বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।
হোয়াইট হাউস থেকে পাল্টা শুল্কের নতুন হার ঘোষণা করার পর বাণিজ্য উপদেষ্টা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমরা যে অবস্থানে পৌঁছেছি, সেটি প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী রেখেছে। তবে আমরা চেয়েছিলাম হারটা আরও নিচে থাকুক।’ অবশ্য একই সঙ্গে তিনি সতর্ক করেন, ‘এখন আত্মতুষ্টির সময় নয়। ভবিষ্যতের বাণিজ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। একদিকে যেমন পোশাক খাত, অন্যদিকে আমাদের কৃষিনির্ভরতা—দুই দিকেই ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের জন্য এটি শুধু শুল্ক ছাড় নয়, বরং কৌশলগতভাবে একটি অর্জন। কারণ এর আগে উচ্চহারের পাল্টা শুল্ক দেশের রপ্তানি খাতকে চাপে ফেলে দিয়েছিল। দীর্ঘ আলোচনার পর এখন তা আরও ১৫ শতাংশ কমিয়ে ২০ শতাংশে নেমেছে—তবে একতরফাভাবে নয়, বরং কিছু প্রতিশ্রুতি ও ভবিষ্যৎ লক্ষ্য নির্ধারণের বিনিময়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আপাতভাবে এই ছাড় বাংলাদেশের জন্য স্বস্তির হলেও এর স্থায়িত্ব নির্ভর করবে দেওয়া প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নের ওপর।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু কালবেলাকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশে অনেকেই স্বস্তি পাচ্ছেন, কারণ ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা—সবাই প্রায় এই হারেই রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বায়ারদের জন্য এটি একটা বাড়তি খরচ। ফলে আমাদের রপ্তানিতে কিছুটা চাপ তৈরি হবে, বিশেষ করে দামের ক্ষেত্রে। তবে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হওয়া যাবে একটি সিজনের রপ্তানি শেষ করার পর।’
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের নেগোসিয়েশন বা দরকষাকষিকে একটি তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এটি বিশ্ববাজারের বৃহত্তর পুনর্বিন্যাসের অংশ। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের মূল প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর যে হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, সেই হিসাবে বাংলাদেশের ওপর আরোপিত শুল্ককে তুলনামূলকভাবে সহনীয় বলছেন তারা।
শুল্ক হ্রাসকে স্বল্পমেয়াদি স্বস্তি হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদ এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর কী শুল্ক নির্ধারণ করে, সেটা এখন বৈশ্বিক বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ দিক নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ। চীনের ওপর শুল্ক বাড়লে দক্ষিণ এশিয়া ও সাউথইস্ট এশিয়ান দেশের জন্য সুযোগ তৈরি হবে, না হলে প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হবে। এই শুল্ক কাঠামো প্রমাণ করে, যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যকে নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত করে দেখছে। এখানে শুধু ঘাটতি নয়, কে তাদের সঙ্গে চুক্তি করে, কে প্রতিশ্রুতি দেয়—সেটাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শুল্কের চাপ কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের দাবি অনুযায়ী বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয় বাংলাদেশ। মার্কিন উড়োজাহাজ নির্মাতা কোম্পানি বোয়িংয়ের কাছে ২৫টি উড়োজাহাজ কেনার ঘোষণা আসে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম, সয়াবিন তেল ও তুলা আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর বলছে, শুধু যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যে শুল্ক কমানোর উদ্যোগেই সেখানে রপ্তানি করা পণ্যে শুল্ক ছাড় মেলেনি। বরং অশুল্ক বাধা, বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা এবং নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ দূর করতে পদক্ষেপ নিতে হয়েছে।
আলোচনার মাধ্যমে সম্পূরক শুল্কের পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে বর্ণনা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায় অংশ নেওয়া বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলকে অভিনন্দন জানিয়ে এক বার্তায় তিনি বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক বাণিজ্য চুক্তি নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের শুল্ক আলোচক দলকে আমরা গর্বের সঙ্গে অভিনন্দন জানাই, যা এক গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বিজয়। এই চুক্তি বাংলাদেশের তুলনামূলক বাণিজ্যিক সুবিধা বজায় রেখেছে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভোক্তা বাজারে প্রবেশাধিকার আরও সম্প্রসারিত করেছে এবং দেশের মৌলিক স্বার্থ সুরক্ষিত করেছে।’
মন্তব্য করুন