সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গতকাল বুধবার আরও দুজন সাক্ষী তাদের সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। তারা হলেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী রিনা মুরমু ও আবু সাঈদকে গুলি করার সময় লাইভ (সরাসরি) সম্প্রচারে থাকা এনটিভির রংপুরে দায়িত্ব পালনকারী সিনিয়র করেসপনডেন্ট এ কে এম মাইনুল হক। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে দুজন পুলিশের গুলি করা নিজে দেখেছেন বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন রিনা মুরমু।
এ ছাড়া সাংবাদিক মাইনুল হক তার সাক্ষ্যে বলেছেন, ‘দুহাত প্রসারিত করে রাস্তায় দাঁড়ানো যুবকের কাছ থেকে মাত্র কয়েক গজের দূরত্বে ১নং গেটের সামনে অবস্থানরত পুলিশ যারা আগে থেকে গুলি করছিলেন, তারা দুহাত প্রসারিত করা যুবককে উদ্দেশ করে গুলি করেন। এই দৃশ্য তখন এনটিভিতে লাইভ সম্প্রচার চলছিল। পুলিশের করা গুলি ওই যুবকের সামনে থেকে বুকে ও পেটে বিদ্ধ হয়।’ গতকাল বুধবার বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ এই সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। এ মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ১৭ আগস্ট দিন নির্ধারণ করা হয়েছে।
এদিকে, শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ৩০ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। গতকাল বুধবার চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২ এই আদেশ দেন। আগামী ২৭ আগস্ট এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য রেখেছেন বলে জানিয়েছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু। প্রসিকিউটর ছিলেন এস এম মইনুল করিম। এ মামলায় ৩০ আসামির মধ্যে ২৪ জন পলাতক।
গ্রেপ্তার থাকা আসামিরা হলেন এএসআই আমির হোসেন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়, ছাত্রলীগ নেতা ইমরান চৌধুরী, রাফিউল হাসান রাসেল ও আনোয়ার পারভেজ। অভিযোগ গঠনের সময় তারা ট্রাইব্যুনালের এজলাসে উপস্থিত ছিলেন। ট্রাইব্যুনাল এসব আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ পড়ে শোনান। এরপর আসামিদের কাছে জানতে চান তারা দোষী না নির্দোষ। আসামিরা সবাই নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। তখন ট্রাইব্যুনাল বলেন, তাহলে তো আপনাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। এ সময় অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চেয়ে করা আসামিদের আবেদন খারিজ করে দেন ট্রাইব্যুনাল। আদালত বলেন, আসামিদের অব্যাহতি দেওয়ার মতো কোনো উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে ট্রাইব্যুনাল তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন এবং সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করেন।
‘দুজন পুলিশ আবু সাঈদকে গুলি করে’:
হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মামলার সাক্ষী রিনা মুরমু তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘ঘটনার দিন আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখান থেকে আমি আবু সাঈদকে গুলি করতে দেখেছি। দুজন পুলিশ আবু সাঈদকে গুলি করে। পরে জানতে পারি তাদের নাম আমির ও সুজন চন্দ্র। এরপর আনুমানিক বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে জানতে পারি আবু সাঈদ মারা গেছেন। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, ছাত্রলীগ ও রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের যারা সরাসরি গুলি করেছিলেন, তারা দায়ী। আমি তাদের বিচার চাই।’
‘সরাসরি সম্প্রচার করা হয় আবু সাঈদকে গুলির দৃশ্য’:
এনটিভির রংপুরে দায়িত্ব পালনকারী সিনিয়র করেসপনডেন্ট এ কে এম মাইনুল হক তার জবানবন্দিতে বলেছেন, ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই দুপুর ২টার আগে থেকে আমি এবং আমার সহকর্মী ভিডিও জার্নালিস্ট আসাদুজ্জামান আরমান রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১নং গেটের সামনে পার্কের মোড় এলাকায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলাম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা রংপুর প্রেস ক্লাব এলাকা থেকে একটি মিছিল নিয়ে আমাদের দিকে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১নং গেটের সামনে আগে থেকেই উপস্থিত পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ সরকারি দলের সমর্থকরা বাধা দেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সেখানে দেখতে পাই। গেটের সামনে একটি সমাবেশ করার চেষ্টা করা হয়। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীদের ওপর লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ, রাবার বুলেট ও শটগানের গুলিবর্ষণ শুরু করা হয়।
তিনি তার সাক্ষ্যে আরও বলেন, দুপুর ২টা ১৩ মিনিটের দিকে আমি আমার সহকর্মী ভিডিও জার্নালিস্ট আরমানের সহযোগিতায় লাইভ সম্প্রচার শুরু করি এবং সেখানকার সামগ্রিক পরিস্থিতি এনটিভির মাধ্যমে সারা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরি। আনুমানিক ২টা ১৭ মিনিটের দিকে এক নম্বর গেটের সামনে রোড ডিভাইডারের একটি কাটা অংশ দিয়ে কালো টি-শার্ট ও কালো প্যান্ট পরিহিত এক যুবক সামনে এগিয়ে এসে দাঁড়ান। এ সময় তিনি দুদিকে দুহাত প্রসারিত করে দেন। দুহাত প্রসারিত করে রাস্তায় দাঁড়ানো যুবকের কাছ থেকে মাত্র কয়েক গজের দূরত্বে ১নং গেটের সামনে অবস্থানরত পুলিশ যারা আগে থেকে গুলি করছিলেন, তারা দু হাত প্রসারিত করা যুবককে উদ্দেশ করে গুলি করেন। এই দৃশ্য তখন এনটিভিতে লাইভ সম্প্রচার চলছিল।’ সাক্ষী আরও বলেন, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ওই যুবক কয়েক পা পেছনে পিছিয়ে বসে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি তার দেহের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে রাস্তার ওপর লুটিয়ে পড়েন। অন্য সহযোদ্ধারা এসে তাকে পার্কের মোড়ের দিকে নিয়ে যান। এনটিভির লাইভে তাকে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য যতক্ষণ পর্যন্ত ক্যামেরায় আসছিল, ততক্ষণ দেখানো হয়। একই সঙ্গে ক্যামেরা ঘুরিয়ে যে পুলিশেরা গুলি করেছিল, লাইভে তাদেরও দেখানো হয়। পরে অন্য সহকর্মীদের মাধ্যমে জানতে পারি তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সূত্রে জানতে পারি, ওই যুবক রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং তার নাম আবু সাঈদ। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে জানতে পারি গুলিবিদ্ধ আবু সাঈদ মৃত্যুবরণ করেছেন। পরে এনটিভির লাইভ সম্প্রচারের সেই ভিডিও এবং একটি মূল ভিডিওর ‘র’ কপি আদালতে দেখানো হয়। সাক্ষ্য গ্রহণের পর রিনা মুরমু এবং মাইনুল হককে এ বিষয়ে জেরা করেন শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম শুনানি করেন। এ সময় অন্য প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, গত ৩ আগস্ট এই মামলায় সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের পর ট্রাইব্যুনালে প্রথম সাক্ষ্য দেন খোকন চন্দ্র বর্মণ। তিনি গত বছরের ১৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় তার সামনে সংঘটিত হতাহতের ঘটনা ও গুলিতে নিজের মুখমণ্ডল বিকৃত হওয়ার বিষয়ে সাক্ষ্য দেন। এরপর ৪ আগস্ট সাক্ষ্য দেন আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে পা হারানো ঢাকা কলেজের মাস্টারের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল ইমরান (২৫) এবং আন্দোলন চলাকালে যাত্রাবাড়ীতে গুলিবিদ্ধ বাম চোখ হারানো পারভীন (২৭)।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গত ১ জুন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। শেখ হাসিনার পাশাপাশি এই মামলায় অভিযুক্ত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ এনে অভিযোগ গঠনের আবেদন করে প্রসিকিউশন। এরপর গত ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এ ছাড়া এই মামলায় দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্যতা উদ্ঘাটনে (অ্যাপ্রোভার) রাজসাক্ষী হতে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের আবেদন মঞ্জুর করেন ট্র্যাইব্যুনাল। গতকালও রাজসাক্ষী চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন। তার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।
‘আবু সাঈদ হত্যার বিচার শুরু’:
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন যখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন ১৬ জুলাই দুপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পার্ক মোড়ে গুলিবিদ্ধ হন আবু সাঈদ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে নিরস্ত্র আবু সাঈদের পুলিশ কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হওয়ার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদেই সোচ্চার হন বহু মানুষ, যাতে আরও গতিশীল হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। ওই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। গত ২৪ জুন এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে তদন্ত সংস্থা। এতে ৩০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। পরে ৩০ জুন প্রসিকিউশন আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগপত্র দাখিল করে, যা ট্রাইব্যুনাল আমলে নেয়। গত ২৮ জুলাই এ মামলার ৩০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের ওপর শুনানি শেষ করে প্রসিকিউশন। গতকাল অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
মন্তব্য করুন