সরকারবিরোধী একদফার আন্দোলন শুরুর পর থেকেই ঢাকায় আন্দোলনের মাঠে ‘সোচ্চার ও সক্রিয়’ নেতাদের বেছে বেছে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলে অভিমত বিএনপির। দলটির দাবি, চলমান আন্দোলন দমাতে গত কয়েক মাসে এমন একডজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যারা সাংগঠনিকভাবে খুবই সোচ্চার ছিলেন। তাদের গ্রেপ্তারে ঢাকায় আন্দোলনে এক ধরনের নেতৃত্ব শূন্যতা দেখা দিয়েছে বলে মনে করেন দলের কেউ কেউ। তাদের অভিমত, এর ফলে ঢাকায় সংগঠনও দুর্বল হয়ে পড়ছে। এদের ‘আন্দোলন সক্ষমতা’ ইতোমধ্যে দলের কাছে পরীক্ষিত ও প্রমাণিত। তাই চূড়ান্ত আন্দোলনের ‘শেষ ধাপ’ শুরুর মুহূর্তে এ বিষয়টি দারুণ ভাবাচ্ছে বিএনপির হাইকমান্ডকে। যদিও দলে প্রতিটি নেতারই যোগ্য রিপ্লেসমেন্ট রয়েছে বলে দাবি বিএনপির।
সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে গত ১২ জুলাই একদফার আন্দোলনের ঘোষণা দেয় গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর থেকে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বিএনপি। এ পর্যন্ত বিএনপিসহ সমমনা জোট ও দলগুলো ঢাকায় পদযাত্রা, মহাসমাবেশ, ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান, গণমিছিল ও
কালো পতাকা মিছিলের কর্মসূচি করেছে। সর্বশেষ গত ২৪ ও ২৫ আগস্ট ঢাকাসহ সারা দেশে কালো পতাকা গণমিছিল করেছে তারা। আগামীকাল শনিবার ঢাকায় ফের গণমিছিল করবে বিএনপি ও যুগপতের শরিকরা। জানা গেছে, সেপ্টেম্বরের শেষ দিক থেকে একদফার আন্দোলনে ভিন্নতা আসবে। আর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগেই আন্দোলন সফল পরিণতিতে নিয়ে যেতে চায় দলটি। মধ্য অক্টোবরের মধ্যেই চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করতে চান নেতারা। তাই অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে ঘেরাওসহ লাগাতার কর্মসূচি আসতে পারে। অবশ্য এর আগে বিচার বিভাগ বা আদালতকেন্দ্রিক আরও কিছু কর্মসূচি নেওয়া হতে পারে, যাতে দেশের বিচার বিভাগ নিয়ে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ সব মহলের নজরে আসে।
বিএনপি নেতারা জানান, গত ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচির পর ২০ আগস্ট ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে দক্ষিণের সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনুকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া গত কয়েক মাসে যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোনায়েম মুন্না, বিএনপির বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা-৪ আসনের সাবেক এমপি সালাহ উদ্দিন আহমেদ, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরব, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা শেখ রবিউল আলম রবি, যুবদলের সাবেক সহসভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর, আলী আকবর চুন্নু, ইউসুফ বিন জলিল (কালু), বর্তমান যুগ্ম সম্পাদক গোলাম মাওলা শাহীন, ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান মুসাব্বির, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবু আফসান মোহাম্মদ ইয়াহিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মজনু ও রবিন কারাগারে থাকলেও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপিতে এখনো কোনো রিপ্লেসমেন্ট দেওয়া হয়নি। মহানগর দক্ষিণে যখন এই অবস্থা, তখন উত্তর বিএনপির নেতৃত্বেও এক ধরনের শূন্যতা দেখা দেওয়ার উপক্রম হয়েছে। দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান ১০ সেপ্টেম্বর আদালতে আত্মসমর্পণ করতে পারেন। গত ৭ আগস্ট আমানের ১৩ বছরের সাজার রায় বহাল রাখেন উচ্চ আদালত। রায়ে বিচারিক আদালতে রায় পৌঁছানোর ১৫ দিনের মধ্যে তাকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। যদিও বিএনপির দাবি, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আমানকে সাজা দেওয়া হয়েছে। চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলন সামনে রেখে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপিতে আমানের এই শূন্যতা দলটির হাইকমান্ডকে ভাবাচ্ছে।
এদিকে মাঠের আন্দোলনে সোচ্চার দল ও অঙ্গসংগঠনের এসব নেতা গ্রেপ্তার হওয়ায় বিএনপি আগামীতে ঢাকায় আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে পারবে কি না, তা নিয়ে এক ধরনের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যদিও বিএনপি থেকে বলা হয়েছে, প্রতিটি নেতারই যোগ্য রিপ্লেসমেন্ট রয়েছে। দলে নেতার কোনো ক্রাইসিস নেই। তবে বাস্তবতা ভিন্ন বলে মনে করছেন দলের অনেক নেতা। তাদের যুক্তি, মাঠের আন্দোলনে ‘সক্রিয়’ এসব নেতার যোগ্য রিপ্লেসমেন্ট সহজ ব্যাপার নয়। প্রতিটি নেতারই প্রচুর সমর্থক, অনুসারী রয়েছে। তারা জানেন, তাদের কর্মী-সমর্থকদের কীভাবে সংগঠিত করে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে হয়। হামলা-মামলা হলে তাদের পাশে দাঁড়ান, জামিনের ব্যবস্থা করেন। তাই কোনো নেতা যখন মাঠে থাকেন না, তখন কর্মী-সমর্থকরা তার অভাব অনুভব করে হতাশ হয়ে পড়েন। বিকল্প নেতৃত্বের পেছনে তাদের দিয়ে কাজ করানো তখন কঠিন হয়ে পড়ে।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুস সালাম বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে অতীতের মতো প্রশাসনকে ব্যবহার করে আবারও ক্ষমতায় থাকতে চায়। সে কারণে তারা মামলা-হামলা, অত্যাচার-নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছে। তবে যতই মামলা-হামলা-গ্রেপ্তার করুক না কেন, আন্দোলনকে দমানো যাবে না। চলমান আন্দোলনের মধ্য দিয়েই সরকারের পতন ঘটবে বলে দাবি করেন তিনি।
মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক কালবেলাকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার চলমান একদফার আন্দোলন দমাতে সাংগঠনিকভাবে মাঠে যারা সক্রিয়, তাদের বেছে বেছে গ্রেপ্তার করছে। জামিন হলেও পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাদের কারাগারে আটক রাখা হচ্ছে। এটা জনবিচ্ছিন্ন এই সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার একটা অপচেষ্টা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নেতাদের গ্রেপ্তার করলেও আন্দোলনে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত চলমান শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই সরকারের পতন ঘটবে। সে লক্ষ্যে সাংগঠনিক পরিকল্পনা মতো কাজ করছি।
মন্তব্য করুন