রাজনীতিতে ‘কালো ছায়া’ যেন জাতীয় পার্টির (জাপা) পিছু ছাড়ছেই না। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাজনীতির ময়দানে কোণঠাসা দলটির একাংশের চলে যাওয়ার পর জাপা পড়তে যাচ্ছে নতুন বিপাকে। আওয়ামী লীগের ‘দোসর’ হিসেবে তকমা দিয়ে জাপা নিষিদ্ধের দাবির সঙ্গে দলটির প্রতীক নিয়েও চলছে টানাটানি। বিভক্ত জাপার তিনটি অংশের প্রতীক নিয়ে বিরোধের দীর্ঘ লড়াইয়ে এবার নতুন করে যোগ হয়েছে লাঙ্গলের আদি দাবিদার। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন পেলে বাংলাদেশ জাতীয় লীগ তাদের ‘আদি প্রতীক’ ফিরে পেতে যুক্ত হবে চতুর্মুখী লড়াইয়ে। জাপার লাঙ্গল হারানোর আশঙ্কার সঙ্গে প্রতীক বরাদ্দ নিয়ে দ্বিধায় পড়তে পারে নির্বাচন কমিশনও।
জাপার নীতিনির্ধারকরা বলছেন, ইসির নিবন্ধিত দলগুলোকে প্রতীক বরাদ্দ দেওয়ার নিয়ম চালু হওয়ার পর লাঙ্গল নিয়ে কোনো দাবিদার ছিল—এমন কোনো দলের নাম তারা শোনেনি। তবে হঠাৎ কেন এই টানাটানি, নিশ্চয়ই দুরভিসন্ধি রয়েছে। ২০০৮ সাল থেকে নিবন্ধন প্রথা চালুর আগে কেউ নির্বাচন করে থাকলেও তারা নিবন্ধিত না হওয়ায় নতুন করে লাঙ্গল প্রতীকের দাবিদার হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কে প্রতীক দাবি করল কি করল না, তাতে তারা মোটেই বিচলিত নন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাপার মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী কালবেলাকে বলেন, ‘নতুন একটি দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় পার্টির প্রতীক হারানোর কোনো বাস্তবতা নেই। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন প্রথা চালু হওয়ার পর থেকেই লাঙ্গল প্রতীক জাতীয় পার্টির। তা ছাড়া কোনো নিবন্ধিত দল লাঙ্গল প্রতীক তাদের বলে দাবি করেছে, এমন কিছুও শুনিনি। যদি কোনো দল নিবন্ধন পাওয়ার পর লাঙ্গল প্রতীক দাবিও করে, তবে তাদের অন্য নতুন প্রতীক বেছে নিতে হবে। লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে কোনো জটিলতার উদ্ভব হলে আইনিভাবে তা মোকাবিলা করব। তা ছাড়া রাতারাতি নির্বাচন কমিশন চাইলেও প্রতীক বরাদ্দ দিতে পারবে না, এটা নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা হবে, সব শেষে শুনানি হবে।’
লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে টানাটানির প্রসঙ্গটি সম্প্রতি আলোচনায় আসে বাংলাদেশ জাতীয় লীগ নামের একটি দল নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনের প্রক্রিয়ার সব শর্ত পূরণের মাধ্যমে নিবন্ধনের দ্বারপ্রান্তে থাকার ফলে। দলটি নিবন্ধন পেতে নির্বাচন কমিশনের সব ধরনের শর্ত এরই মধ্যে পূরণ করেছে। দলটির নেতাদের দাবি, ইসির নিবন্ধন পেলে তাদের আদি প্রতীক ফিরে পেতে চাইবে। কারণ নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনের আবেদন করেও না পাওয়ায় এতদিন লাঙ্গলের দাবি করতে পারেনি। দলটি প্রতিষ্ঠার পর একাধিক নির্বাচনে দলের নেতারা নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে জয় পেয়েছেন, সুতরাং লাঙ্গলের আদি দাবিদার বাংলাদেশ জাতীয় লীগ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্বাচন কমিশন ৫৬ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত দল বাংলাদেশ জাতীয় লীগকে নিবন্ধন দিতে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠার পর এই দলটির প্রথম প্রতীক ছিল লাঙ্গল। এখন নিবন্ধন পাওয়ার পাশাপাশি সেই প্রতীক ফিরে পেতে চায় তারা।
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পাকিস্তানের স্বৈরশাসনের আমলে ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে জাতীয় লীগ গঠিত হয়। ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে ঢাকা-৩ আসন থেকে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন আতাউর। তবে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি জাতীয় লীগের হয়ে ঢাকা-১৯ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ঢাকা-২১ আসন থেকে সংসদ সদস্য পদে জয়ী হন। একই নির্বাচনে মফিজুল ইসলাম কুমিল্লা থেকে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও ১৯৮৪ সালের ৩০ মার্চ সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন। এতে জাতীয় লীগ বিলুপ্ত হয়। রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হলে ২০০৮ সাল থেকে একাধিকবার নিবন্ধনের আবেদন করেও নিবন্ধ পায়নি জাতীয় লীগ। প্রতীকও দিয়ে দেওয়া হয়েছে অন্য দলকে।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় লীগের চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আশার খবর হচ্ছে, ইসি অবশেষে আমাদের দলের নিবন্ধন দিতে যাচ্ছে। এই প্রতীক (লাঙ্গল) আমাদের আদি প্রতীক। দলের প্রতিষ্ঠাতা আতাউর রহমান খান লাঙ্গল প্রতীক নিয়েই নির্বাচিত হয়েছিলেন। কুমিল্লা থেকে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন অধ্যাপক মফিজুল ইসলাম। সুতরাং লাঙ্গল প্রতীকের আদি দাবিদার বাংলাদেশ জাতীয় লীগ। আমাদের প্রতীক লাঙ্গল ফিরে পেতে নির্বাচন কমিশনে দাবি জানাব।’
এর আগে থেকেই জাপার নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদেরের নেতৃত্বাধীন দলের অংশের সঙ্গে টানাপোড়েন চলছে দলটির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদপন্থি ও আনিসুল ইসলাম মাহমুদের অংশের। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে আলাদা হওয়ার পর নীরব থাকলেও রওশনপন্থিরা এখন লাঙ্গল প্রতীক দাবি করছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গত আগস্টে আলাদা হয়ে যাওয়া আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বাধীন আরেকটি অংশ। জাপার তিনটি অংশই ইসিতে লাঙ্গল প্রতীকের দাবি জানিয়ে আসায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন জাতীয় পার্টির প্রতীক লাঙ্গলের প্রকৃত দাবিদার নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ার কথা জানান।
এরপর, রওশন ও আনিসুলপন্থিরা লাঙ্গল প্রতীকের দাবি জানিয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিও দেন। পরে জাপার জি এম কাদেরপন্থিরাও নির্বাচন কমিশনে গিয়ে বৈঠক করে প্রতীকের দাবি জানিয়ে আসেন। প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেওয়া জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘দলের নিবন্ধন ও লাঙ্গল প্রতীক চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের নামে থাকবে, যেভাবে বর্তমানে বহাল রয়েছে। সম্প্রতি জাতীয় পার্টির নামে বহিষ্কৃত কিছু ব্যক্তি একটি কাউন্সিল করে নির্বাচন কমিশনে দলের নিবন্ধন ও প্রতীকের দাবি জানালেও সেটি আইনিভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।’
এরই মধ্যে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারের নেতৃত্বাধীন অংশ নিজেদের মূল জাপা দাবি করে ইসিতে চিঠি দিয়েছে। ২০০৮ সাল থেকে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও প্রতীক বরাদ্দের প্রথা চালু হওয়ার পর থেকে জাতীয় পার্টি চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে অংশ নিয়েছে। এমনকি জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের আসনেও বসেছে একাধিকবার।
মন্তব্য করুন