কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০২:১২ এএম
আপডেট : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:১৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ভিসা নীতি প্রয়োগের চিন্তা গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ

প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিক ও বিশ্লেষকরা
ভিসা নীতি প্রয়োগের চিন্তা গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ

সাংবাদিকদের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি প্রয়োগের চিন্তা মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপের শামিল বলে মনে করেন সাংবাদিক ও বিশ্লেষকরা। বিশ্বের প্রভাবশালী দেশের বিধিনিষেধের এই খড়্গ সাংবাদিকদের ওপর অযাচিত চাপ তৈরি করবে বলেও তাদের অভিমত।

তারা বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে ভিসা নীতির আওতায় আনার কথা নয়। তারপরও যদি তারা এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নিয়ে থাকে, তা হবে দুর্ভাগ্যজনক ও বাকস্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপের শামিল। এটি হবে মার্কিন সরকারের দ্বৈত নীতির বহিঃপ্রকাশ। একদিকে তারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলবে, অন্যদিকে ভিসা নীতির ভয় দেখিয়ে গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরবে—এটা হতে পারে না।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ওপর ভিসা নীতি প্রয়োগ হতে পারে—সম্প্রতি এমন কথা জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এর পরই বিষয়টি নিয়ে নানা মহলে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। যদিও পিটার হাসের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেন, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব নয়, বরং বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দলের সদস্যদের ওপর ভিসা নীতি কার্যকর হয়েছে। গতকাল সোমবার নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি।

বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতিনিধি মিলারকে প্রশ্ন করেন, ‘বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত গত ২৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে নতুন ভিসা বিধিনিষেধে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বের অন্তর্ভুক্তির ঘোষণা দিয়েছেন এবং উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। আপনি কি মনে করেন, নিষেধাজ্ঞা সংবাদমাধ্যমে আরোপ হলে মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানকে দুর্বল করবে?’

জবাবে মিলার বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত যা বলেছি এবং কাদের জন্য প্রযোজ্য হবে, আমরা নির্দিষ্ট ব্যক্তির নাম ঘোষণা করিনি। কারণ, মার্কিন ভিসার রেকর্ডগুলো গোপনীয় তথ্য। স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য, ক্ষমতাসীন দল এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের জন্য এই নীতি প্রযোজ্য হবে।’

মিলারের সঙ্গে রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের ভিন্নতা থাকলেও বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে ভিসা নীতির আওতায় আনার বিষয়টি মার্কিন সরকারের চিন্তায় রয়েছে। তা না হলে দেশটির প্রভাবশালী দেশের রাষ্ট্রদূত এমন কথা বলতেন না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘রাষ্ট্রদূত পিটার হাস যে কথা বলেছেন এবং সোমবার মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্রের বক্তব্যের মধ্যে পার্থক্য দেখছি। বিষয়টি স্পষ্ট করা দরকার। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে উদ্যোগ নিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমও পর্যবেক্ষকদের মতো নির্বাচন পর্যবেক্ষণে বড় ভূমিকা রাখে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলা আছে। আমার মনে হয় না গণমাধ্যমের ওপর ভিসা নীতির প্রয়োগ করবে। তারপরও কথাটা যেহেতু উঠেছে, এটি স্পষ্ট করা উচিত।’

সাংবাদিক নেতারা বলছেন, গণমাধ্যমের ওপর মার্কিন ভিসা নীতি কার্যকর করার চিন্তা থাকলে তা হবে দুর্ভাগ্যজনক ও বাকস্বাধীনতার ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপের শামিল। একদিকে মার্কিন সরকার বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের কথা বলছে, অন্যদিকে গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরার চিন্তা করছে। এটি বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নীতি বলেও মনে করেন শীর্ষ সাংবাদিক নেতারা।

জানতে চাইলে বিএফইউজে-বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ওমর ফারুক কালবেলাকে বলেন, ‘ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস গণমাধ্যমকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনার বিষয়ে যে কথা বলেছেন, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।’

এ ধরনের চিন্তা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর এক ধরনের হস্তক্ষেপ—এমন মন্তব্য করে এই সাংবাদিক নেতা বলেন, ‘গণমাধ্যমের সঙ্গে রাজনীতির বিরোধ কেন বুঝতে পারি না। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে কোনো দেশের বাধা দেওয়া অন্যায়। আমরা মাঠে কাজ করতে গিয়ে রাজনীতির বাস্তব চিত্র তুলে ধরি। তার মানে এই নয়, সাংবাদিকরা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কিংবা সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করতে পারেন।’

তিনি বলেন, ‘আমেরিকা যদি বাকস্বাধীনতা বিশ্বাস করে, তাহলে গণমাধ্যমের ওপর কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা আনতে পারে না। এটি সরাসরি বাকস্বাধীনতার ওপর আক্রমণ। সাংবাদিকরা ভোট ডাকাতি করে না, তারা গণতান্ত্রিক ভোট প্রক্রিয়ায় কোনো অবস্থাতেই বাধার কারণ নয়। এ প্রেক্ষাপটে মার্কিন চিন্তাভাবনা একেবারেই অযৌক্তিক।’

প্রয়োজনে এ বিষয়ে আলোচনা করে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানানো হবে বলেও বিএফইউজে সভাপতি জানান।

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত কালবেলাকে বলেন, গণমাধ্যমকে মার্কিন সরকারের ভিসা নীতির আওতায় আনার বিষয়টি স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে পরোক্ষ হস্তক্ষেপ। এ ধরনের পদক্ষেপ দেশের গণমাধ্যমকে সংকুচিত করবে বলেও মনে করেন তিনি।

বিষয়টি সম্পর্কে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে ব্যাখ্যা দাবি করবেন জানিয়ে শ্যামল দত্ত বলেন, ‘কীভাবে ভিসা নীতির প্রয়োগ হবে আমরা কিছুই জানি না। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে কেন বা কীভাবে যুক্ত করা হবে, এ সম্পর্কে জানার প্রয়োজন আছে। নির্বাচন কীভাবে হবে, এটির নিয়ন্ত্রক তো গণমাধ্যম নয়। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে ভিসা নীতিতে আনার চিন্তা সত্যিই উদ্বেগের বিষয়। যা স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থি উল্লেখ করে ভোরের কাগজ সম্পাদক বলেন, এ ব্যাপারে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে আমরা বৈঠকে বসব।’

গণমাধ্যম নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসতে পারে, মার্কিন সরকারের এমন চিন্তাকে অনধিকার চর্চা হিসেবে মন্তব্য করে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘বিশ্বের পরাশক্তি হিসেবে ঢাকায় আমেরিকার কূটনীতিকের এমন বক্তব্য গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি অস্থিরতা তৈরি করেছে। এ রকম চিন্তা স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধার পাশাপাশি পেশাদার গণমাধ্যমকর্মীদের ভীত করে তোলে।’

তিনি বলেন, ‘আমেরিকার গণমাধ্যমগুলোর রাজনৈতিক দর্শন আছে, সে দেশের গণমাধ্যম নির্বাচনের সময় ঘোষণা দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতি নিজেদের সমর্থন ও অবস্থান স্পষ্ট করে। এদিক বিবেচনায় সংবাদপত্র নিরপেক্ষ নয়। নিষেধাজ্ঞা দিয়ে মার্কিন সরকার আসলে কী বোঝাতে চায়, আমরা বুঝি না। আমরা সঠিক পথে আছি। তাদের এ সিদ্ধান্ত অসম্মানজনক ও অনধিকার চর্চা বলেও মনে করেন এই সাংবাদিক নেতা।’

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) আরেক অংশের সহসভাপতি রফিক মুহম্মদ কালবেলাকে বলেন, ‘আমেরিকা মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী; কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তারা কীভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে? এদিক থেকে তাদের অবস্থান বিপরীতমুখী। মোট কথা হলো, একটা স্বাধীন দেশের ওপর কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞাই কাম্য হতে পারে না। গণমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন না।’

তবে বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন কালবেলাকে বলেন, ‘মার্কিন ভিসা নীতির আওতাভুক্ত গণমাধ্যম বলতে তাদেরই বোঝানো হয়েছে, যারা গণমাধ্যমের লেবাস পরে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কাজ করে। জনগণের ভোটাধিকারকে যারা নাকচ করছে, মার্কিন ভিসা নীতি অনুযায়ী তারাই গণতন্ত্রের শত্রু। গণমাধ্যমের লেবাস পরে যদি কেউ তা করে, তাহলে সেই গণমাধ্যম শত্রু।’

তার মতে, ‘করপোরেট হাউসের মিডিয়া উইং আর গণমাধ্যম তো এক জিনিস নয়। অথবা কোনো সরকারের প্রোপাগান্ডা উইং আর গণমাধ্যম এক জিনিস নয়। সেই ধরনের গণমাধ্যম নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসতে পারে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ভৈবর নদে তলিয়ে গেল সুন্দরবনের টুরিস্ট জাহাজ

অপহরণ করে ১০ কোটি টাকা আদায়ের মামলায় লিপটন কারাগারে 

আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনায় আ.লীগ নেতাসহ গ্রেপ্তার ২১

তারেক রহমানের বক্তব্য বিকৃত করছে একটি গোষ্ঠী : আবিদ

জামায়াত কী হিন্দুদের স্বর্গের টিকিটও দেবে : সেলিম জাহাঙ্গীর

ঢাকা-১৮ আসনে কফিল উদ্দিনের উদ্যোগে উঠান বৈঠক

সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ / রাজনৈতিক হয়রানির অভিযোগ তুলে হত্যা মামলা প্রত্যাহারের পাঁয়তারা 

নৌকা উল্টে  কর্ণফুলীতে ভেসে গেল সাড়ে ১২ টন মাছ

গাজা যুদ্ধবিরতি নিয়ে ইসরায়েল-হামাস পরোক্ষ আলোচনা শুরু

নির্বাচন পেছানোর চেষ্টা গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকারবিরোধী : নীরব

১০

বজ্রপাত নিয়ে বিশেষজ্ঞের সতর্কতা

১১

প্রথমবার প্রকাশ্যে আসছেন ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের নেতা

১২

নতুন ২ জাতীয় দিবসের ছুটি নিয়ে যা জানা গেল

১৩

সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি

১৪

নির্বাচন নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র হতে দেওয়া হবে না : পাপিয়া

১৫

ভারতের ভিসা নিয়ে সুখবর দিলেন বিক্রম মিশ্রি

১৬

স্ত্রীর অভিযোগের জবাব দিলেন আবু ত্বহা আদনান

১৭

শেখ রেহানার পরিবারের বিরুদ্ধে ৩ জনের সাক্ষ্য

১৮

আকাশে ফানুসের জ্যোৎস্না, হৃদয়ে প্রবারণা পূর্ণিমার আলো

১৯

ঢাকা অভিমুখে লং মার্চের হুঁশিয়ারি হেফাজতের

২০
X