ময়মনসিংহ নগরীর পুরোহিতপাড়া এলাকার বাসিন্দা ইয়াছিন আরাফাত শাওন (৪২)। রাজনৈতিক পরিচয় তিনি মহানগর যুবলীগের বহিষ্কৃত সদস্য। চাঁদাবাজি, মানুষকে জিম্মি করে টাকা আদায়, বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর মৃত্যুর খবর পেয়ে চিকিৎসকদের তুলে নিয়ে টাকা আদায়সহ তার বেপরোয়া সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এখন ‘ওপেন সিক্রেট’। সাধারণ মানুষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সবাই সবকিছু জেনেও নীরব। তার প্রভাবের কারণে মুখ খোলার সাহস পান না কোনো ভুক্তভোগী। সর্বশেষ নিজের গাড়িকে সাইড না দেওয়ায় ট্রাকচালককে মারধরের এক পর্যায়ে সেই মারামারি থামাতে গিয়ে ছুরিকাঘাতে এক যুবককে হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছেন শাওন। এ ঘটনায় তাকে প্রধান আসামি করে থানায় একটি মামলা করেছেন নিহতের মা। কিন্তু ঘটনার পর থেকে এখনো শাওনকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
সাড়ে তিন বছর আগে এক অভিযানে শাওন ও তার ভাই মাসুদ পারভেজসহ ৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব। ওই সময় তার কাছ থেকে একটি স্নাইপিং রাইফেলের টেলিস্কোপিং সাইট, দুটি পিস্তল, একটি রিভলবার, তিনটি ম্যাগাজিন, দুটি শটগান, সাতটি রামদা, বিপুল পরিমাণ দেশি অস্ত্র ও গোলাবারুদ জব্দ করা হয়। এ ছাড়া জব্দ করা হয় ইয়াবা এবং অস্ত্র তৈরির বিপুল সরঞ্জাম। শাওনকে তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে উল্লেখ করে গ্রেপ্তারের পর সংবাদ সম্মেলন করেছিল র্যাব-১৪। গ্রেপ্তারের পর সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে বহিষ্কার করে যুবলীগ। পরে জেল থেকে বেরিয়ে ফের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়ান তিনি। এরপর রাজনৈতিক ছায়ায় আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন শাওন।
পুলিশ রেকর্ড বলছে, শাওনের বিরুদ্ধে থানায় ৯টি মামলা রয়েছে। মামলাগুলোর মধ্যে অস্ত্র, নারী নির্যাতন, মাদক ও দ্রুত বিচার আইনের মামলা রয়েছে। শাওনের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে প্রথম নারী নির্যাতন আইনে একটি মামলা হয়। মামলার পর মাস্তান হিসেবে আরও পরিচিতি পেতে থাকেন তিনি। ২০১৭ সালে ময়মনসিংহ মহানগর যুবলীগের কমিটিতে সদস্য পদ বাগিয়ে নেন শাওন। এরপর রাজনৈতিকভাবে শুরু হয় তার উত্থান। সময়ে সময়ে একেক রাজনৈতিক গ্রুপের আশ্রয়ে চলতে থাকে তার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। ২০১৭ সাল থেকেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে মামলা হতে শুরু করে।
গত ২৩ জুলাই ত্রিশাল উপজেলার চিকনা মনোহর এলাকার জান্নাতুল ফেরদৌস সম্প্রতি ময়মনসিংহ নগরীর ব্রাþহ্মপল্লি ফাইজা হেলথ কেয়ার সেন্টারে অপচিকিৎসায় মারা যান বলে অভিযোগ ওঠে। জান্নাতুলের অস্ত্রোপচার করেছিলেন হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. নূরুল আমিন। রোগীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ায় উত্তেজনা দেখা দেয়। এক পর্যায়ে চিকিৎসক নূরুল আমিনকে তুলে নিয়ে যায় শাওন ও তার বাহিনী। পরে টাকা আদায় করে গভীর রাতে ওই চিকিৎসককে ছেড়ে দেয় তারা।
গত ১০ জুলাই রাতে নগরীর ব্রাহ্মপল্লির নিউ রুম্পা নার্সিং হোম অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নুসরাত জাহান নূপুর নামে দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। নাকের পলিপাসের চিকিৎসা করাতে গিয়ে অস্ত্রোপচার টেবিলেই মৃত্যু হয় ওই শিক্ষার্থীর। মৃত্যুর পর তার স্বজনরা হাসপাতালের একটি কক্ষ ভাঙচুর করেন। খবর পেয়ে শাওনের দল তুলে নিয়ে যান অ্যানেসথেসিয়া চিকিৎসক আশরাফুল আলমকে। ওই সময় নূপুরের স্বজনরা মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে কোনো অভিযোগ করতে রাজি হননি। সূত্র জানায়, চিকিৎসককে তুলে নেওয়ার পর বিষয়টি মিটমাট করে দেওয়ার জন্য অন্তত ২০ লাখ টাকা নেয় শাওনের দল।
অভিযোগ রয়েছে, বর্তমানে শাওন গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদের আশ্রয়ে আছেন এবং প্রতিমন্ত্রীর সমর্থনে নানা কর্মসূচিও পালন করছেন তিনি। গত শনিবার প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদের নির্বাচনী এলাকা ফুলপুর-তারাকান্দায় যুবলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানেও দলবল নিয়ে সঙ্গে ছিলেন শাওন। অনুষ্ঠান থেকে ময়মনসিংহ শহরে ফেরার পথেই হত্যার ঘটনা ঘটান শাওন।
জানা গেছে, ফুলপুর-তারাকান্দায় যুবলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান শেষে গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ টোলপ্লাজা হয়ে ময়মনসিংহ নগরে আসছিলেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে প্রতিমন্ত্রীর গাড়ি পুলিশ পাহারায় টোলপ্লাজা অতিক্রম করে চলে গেলেও তার বহরের একটি মাইক্রোবাস গাড়ি সাব্বির ফিলিং স্টেশনের বিপরীতে একটি ট্রাকের পেছনে আটকা পড়ে। সেই ট্রাক থেকে টোল তোলা হচ্ছিল। সেই ট্রাকটি বহরের মাইক্রোবাসটিকে সাইড না দেওয়ায় ওভারটেকের সময় গাড়িতে ঘষা লাগে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে গাড়িতে থাকা যুবলীগের নেতাকর্মীরা বের হয়ে ট্রাকচালককে নামিয়ে মারধর করেন। ওই সময় স্থানীয় আব্দুর রাজ্জাক রাকিবসহ সেখানে কয়েকজন ঝগড়া থামাতে যান। এ সময় তাদের ওপর অস্ত্র নিয়ে হামলা করে শাওনের দলবল। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, হামলার পর শাওন দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। ওই সময় রাকিব ছাড়াও আরও দুজন বাসচালক ছুরিকাহত হন। ঘটনার সময় স্থানীয় লোকজন হামলায় জড়িত মাজহরুল ইসলাম (২৪) নামে একজনকে আটক করে পুলিশে দেয়।
হত্যার ঘটনায় নিহত রাকিবের মা হাসি বেগম বাদী হয়ে থানায় একটি মামলা করেছেন। এতে ইয়াছিন আরাফাত শাওন, তার দুই ভাই পারভেজ ও প্রান্তসহ ১৬ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও অন্তত ১০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
নিহতের চাচা আবু বক্কর সিদ্দিক সাগর বলেন, ট্রাকচালককে মারামারি থেকে রক্ষা করতে গিয়ে আমার ভাতিজা খুন হয়। শাওনের নেতৃত্বে তাকে মাথায় কোপ ও ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়। যারা হত্যায় জড়িত সিসিটিভি ফুটেজে তাদের স্পষ্ট দেখা গেছে।
এদিকে টোলপ্লাজা এলাকায় একজনকে হত্যা ও দুই বাসচালককে ছুরিকাঘাতের ঘটনায় রোববার সকালে বাস চলাচল বন্ধ রেখে বিক্ষোভ কর্মসূচি করেছেন পরিবহন শ্রমিকরা। ময়মনসিংহ মোটরযান শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সানোয়ার হোসেন চানু বলেন, বিনা কারণে সন্ত্রাসীরা একজনকে খুন এবং দুই বাসচালককে আহত করেছে। এ ঘটনায় যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়। পুলিশ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সন্ত্রাসীদের ধরতে না পারলে আমরা কঠোর কর্মসূচিতে যাব।
ময়মনসিংহ মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক রাসেল পাঠান বলেন, মহানগর যুবলীগের সদস্য হিসেবে পরিচয় দিলেও শাওন আমাদের সংগঠনের কেউ নয়। ২০২০ সালে র্যাবের হাতে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তারের পর তাকে যুবলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এর পর থেকে তাকে যুবলীগের কোনো বর্ধিত সভায় ডাকা হয়নি।
ময়মনসিংহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শামীম হোসেন কালবেলাকে বলেন, হত্যার ঘটনায় এক আসামিকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা ও থানা যৌথভাবে সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে।
গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ কালবেলাকে বলেন, আব্দুর রাজ্জাক রাকিব নিহতের ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। পুলিশ দোষীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।