তপশিল ঘোষণার পর একদফা আন্দোলনের কৌশলও বদলাচ্ছে বিএনপি এবং সমমনা দল ও জোট। বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, আগামী দিনে আন্দোলন কর্মসূচিতে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে মাঠে নামতে দলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ৩০ নভেম্বর। তারা সেই পর্যন্ত চলমান আন্দোলন অব্যাহত রাখতে চান। তাদের বিশ্বাস, এমনিতেই নানাবিধ চাপে থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর কূটনৈতিক চাপ আরও বাড়বে। বিএনপির শীর্ষ নেতারা এ সময়জুড়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করবেন। পরে পরিস্থিতি বুঝে পদক্ষেপ নিতে চায় দলটি। তপশিল ঘোষণার পরপরই নির্বাচন কমিশন ঘেরাওয়ের আলোচনা থাকলেও এখন ‘অসহযোগ’ কর্মসূচির মধ্যেই কমিশন ঘেরাও কর্মসূচির চিন্তা-ভাবনা চলছে। এককথায় কর্মসূচি পালনে কঠোর হচ্ছে বিএনপি ও মিত্ররা।
৪৮ ঘণ্টার হরতাল শুরু আজ : পঞ্চম দফার অবরোধ শেষ হওয়ার আগের দিন গত বৃহস্পতিবার ৪৮ ঘণ্টার হরতাল কর্মসূচির ঘোষণা দেয় বিএনপি ও এর মিত্ররা। একদফা দাবি আদায় এবং নির্বাচন কমিশনের ‘একতরফা’ তপশিল ঘোষণার প্রতিবাদে ৪৮ ঘণ্টার হরতাল আজ ভোর ৬টায় শুরু হয়েছে। ঢাকাসহ সারা দেশে আগামী ১৯ ও ২০ নভেম্বর (রোববার থেকে মঙ্গলবার) ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ঘোষণা দেওয়া হয়। এ কর্মসূচিতে সমর্থন জানিয়ে পৃথকভাবে হরতাল পালনের ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ যুগপৎ আন্দোলনের শরিক গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, বাংলাদেশ গণঅধিকার পরিষদ, লেবার পার্টি ও এলডিপি।
এদিকে গতকাল সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় আগারগাঁওয়ের তালতলা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বিহঙ্গ পরিবহনের একটি বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এর ৪০ মিনিট পর গুলিস্তানে কমল পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। রাত ১২টার দিকে ধানমন্ডির ল্যাবএইড হসপিটালের সামনে মৌমিতা পরিবহনের একটি বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। কাছাকাছি সময়ে মিরপুরের কালশী রোডে বসুমতি পরিবহনের আরেকটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে সন্ধ্যায় গাজীপুরের শ্রীপুরে হরতাল সমর্থনে মশাল মিছিলে কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। একই সময় সিলেটে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা তপশিল বাতিলের দাবি এবং রোববার থেকে ৪৮ ঘণ্টার হরতালের সমর্থনে মশালমিছিল করেন। পরে নেতাকর্মীরা বন্দরবাজার করিমউল্লা মার্কেটের সামনে পৌঁছালে সেখানে মশাল সড়কের ওপর ফেলে আগুন জ্বালিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। একপর্যায়ে পুলিশ সেখানে উপস্থিত হয়ে ফাঁকা গুলি ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
গতকাল শনিবার বিকেলে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, হরতালকে সাফল্যমণ্ডিত ও সর্বাত্মক শান্তিপূর্ণভাবে পালনের জন্য সারা দেশের নেতাকর্মী ও জনগণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। আপনারা সাহস নিয়ে বুক চিতিয়ে রাজপথে দাঁড়াবেন। সমমনা দল ও জোট এবং গণতন্ত্রকামী সব মানুষকে এই হরতাল পালনের আহ্বান জানাচ্ছি।
গত ২৮ অক্টোবর ঢাকার নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশ পুলিশ পণ্ড করে দেওয়ার পর সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে বিএনপিসহ সমমনা জোটগুলো ২৯ অক্টোবর সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল করে। এরপর পাঁচ দফায় ১১ দিন সারা দেশে অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
কর্মসূচি পালনে কঠোর হচ্ছে বিএনপি: দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা হলেও নির্বাচন প্রতিহতের জন্য বিএনপি নেতাকর্মীরা প্রস্তুত। আগামী দিনে ঢাকাসহ সারা দেশে একযোগে কর্মসূচি আরও জোরদার এবং কঠোরভাবে পালন করতে চায় বিএনপি। এ সিদ্ধান্ত মোতাবেক দায়িত্বশীল নেতারা যার যার স্থান থেকে কাজ করছেন। দলটির তৃণমূলের নেতারা জানান, গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ ক্ষমতাসীন সরকার পরিকল্পিতভাবে পণ্ড করে দিয়েছে। এখন দেশব্যাপী গ্রেপ্তারের নামে সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে। এর মাধ্যমে বিএনপির নেতাকর্মীদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। কারও বাসাবাড়িতে তল্লাশির নামে ঘরবাড়ি ও আসবাব ভাঙচুর করা হচ্ছে। যে কারণে অধিকাংশ নেতাকর্মী ঘরে কিংবা আত্মীয়ের বাসায়ও থাকতে পারছেন না। ইউনিয়ন থেকে মহানগর পর্যায়েও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিএনপি ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করছে। পরিস্থিতি এমন যে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ধানক্ষেত, বাগান, বাঁশঝাড় এমনকি খোলা আকাশের নিচেও মানবেতর দিনাতিপাত করছেন। এ অবস্থায়ও প্রত্যেক নেতাকর্মী আন্দোলনের মাঠে থাকার বিষয়ে অনড়। ভয়ভীতি উপেক্ষা করে তারা যে কোনো মূল্যে আন্দোলনের সফলতা চান।
এ প্রসঙ্গে ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির সভাপতি এমএ মজিদ কালবেলাকে বলেন, বর্তমান সরকার অবৈধ, অগণতান্ত্রিক ও ভোট চোর। এ সরকার দেশের কোনো আইন মানে না। সুতরাং এ সরকারের অধীনে বিএনপি এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনে থাকা শরিক দলগুলো নির্বাচনে যাবে না। এটিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।
দিনাজপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বখতিয়ার আহমেদ কচি বলেন, হামলা-মামলায় আন্দোলন থেমে থাকবে না। তারা এখন না ফেরার অবস্থানে চলে গেছেন। নেত্রকোনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. আনোয়ারুল হক বলেন, প্রত্যেক নেতাকর্মী কষ্ট করে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কর্মসূচি সফল করতে মাঠে রয়েছে। চাঁদপুর জেলা বিএনপির সদস্য ডা. সরকার মাহবুব আহমেদ শামীম বলেন, সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবি এবং প্রহসনের নির্বাচনী তপশিলের প্রতিবাদে হরতাল কর্মসূচি সর্বাত্মকভাবে পালন করা হবে। শেষ পর্যন্ত রাজপথে থেকে দাবি আদায় করা হবে বলে তিনি জানান।
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, একতরফা তপশিলের প্রতিবাদে দেশে ৪৮ ঘণ্টার হরতাল পালিত হবে। জনগণ এ সরকারকে বিদায় করেই ছাড়বে ইনশাআল্লাহ।
মাঠে থাকবে জামায়াতসহ শরিকরা: তপশিল প্রত্যাখ্যান করে ৪৮ ঘণ্টা হরতালের সমর্থনে দফায় দফায় মিছিল-সমাবেশ করেছে জামায়াতে ইসলামীসহ যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলো। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে একতরফা নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা দিয়েছেন এসব দলের নেতারা। তপশিলকে নীলনকশা আখ্যা দিয়ে প্রতিবাদে জামায়াত ঘোষিত ১৯ ও ২০ নভেম্বর ৪৮ ঘণ্টার হরতাল কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে সফল করার আহ্বান জানিয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত আমির ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান। গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, সরকারের একগুঁয়েমি, হঠকারিতা ও ভোটারবিহীন নির্বাচনের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার লক্ষ্যেই হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করতে আমরা বাধ্য হয়েছি। একতরফা ফরমায়েশি তপশিলের প্রতিবাদে জামায়াতে ইসলামী ৪৮ ঘণ্টার হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। তিনি হরতাল কর্মসূচিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়ে সফল করতে সর্বস্তরের নেতাকর্মী এবং দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।
অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, জনগণের মতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে অবশ্যই এই তপশিল প্রত্যাহার এবং ঐকমত্য ও সমঝোতার পর ইসিকে নতুনভাবে নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আহ্বান জানাচ্ছি। নতুবা উদ্ভূত যে কোনো পরিস্থিতির দায় ষড়যন্ত্রকারী সরকার এবং তথাকথিত নির্বাচন কমিশনকেই বহন করতে হবে।
গণতন্ত্র মঞ্চের কয়েকজন নেতা বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে একতরফা নির্বাচন আয়োজনের তপশিল প্রত্যাখ্যান করেছি। সেইসঙ্গে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক নির্বাচন কমিশনকেও প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশের জনগণ। চলমান আন্দোলনে দেশবাসী যেভাবে শান্তিপূর্ণ ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলন চালিয়ে গেছেন, সেভাবে এগিয়ে যেতে থাকলে; এই প্রহসনের তপশিলের সঙ্গে সঙ্গে এই লেজুড়বৃত্তিক ইসি ও অবৈধ ভোট ডাকাত সরকারের পতন অবশ্যম্ভাবী। তারা জনগণকে সরকারের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে ৪৮ ঘণ্টার হরতাল শান্তিপূর্ণভাবে চালিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানান।
হরতালের সমর্থনে মিছিল-পিকেটিং: এদিকে হরতালের সমর্থনে গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও মশাল মিছিল করেন বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা। গতকাল সন্ধ্যায় মালিবাগ বিশ্বরোডে মশাল মিছিল করেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। এতে নেতৃত্ব দেন বিএনপির সহ-স্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল। রামপুরার আবুল হোটেল-কাঁচাবাজার এলাকায় মশাল মিছিলে নেতৃত্ব দেন মহানগর উত্তর ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক জসিম শিকদার রানা। এ সময় মহানগর উত্তর ছাত্রদলের সাবেক নেতা আব্দুল্লাহ আল হামিদ নীরব, রিমন, তৌহিদুল ইসলাম আরিফ, পাভেল, সোহাগ, আরিফ বিল্লাহ, ইমন, নাসির তন্ময়, হাফিজ, জুয়েল, রাহুল, আরিফ, জসিমসহ বিভিন্ন থানার নেতারা। এ ছাড়া গতকাল বিকেলে সিলেট জেলা ও মহানগর, কক্সবাজার, সিরাজগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে জামায়াতে ইসলামী।