দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এক্ষেত্রে আচরণবিধি রক্ষার বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় দুই শতাধিক প্রার্থী ও সমর্থককে শোকজ করা হয়েছে। তলব করা হয়েছে হেভিওয়েট কয়েকজন প্রার্থীকেও। এবার আচরণবিধি লঙ্ঘনে বারবার দেওয়া ইসির সতর্কবার্তাকে পাত্তা না দেওয়া প্রার্থী ও সমর্থকের বিরুদ্ধে মামলায় যাচ্ছে কমিশন। এরই মধ্যে তিন প্রার্থী ও সমর্থকের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করা হয়েছে। আরও চারজন প্রার্থী ও সমর্থকের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। ইসি সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
জানা যায়, নির্বাচনী প্রচার শুরুর আগেই প্রার্থীদের আচরণবিধি ভঙ্গের হিড়িক পড়ে। শুরুতে কমিশন এ ব্যাপারে নীরবতা পালন করলেও সমালোচনার মুখে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করে ইসি। আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় এরই মধ্যে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি গতকাল পর্যন্ত ২০২ জন প্রার্থী ও তাদের সমর্থককে শোকজ করেছে। কারণ দর্শানোর জন্য তলব করা হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র অনেক হেভিওয়েট প্রার্থীকে। এর মধ্যে কয়েকজন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী, স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং প্রার্থীদের অনুসারীরাও রয়েছেন। এর পরও আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা অব্যাহত থাকায় নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট এলাকার নির্বাচন কর্মকর্তাদের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।
সূত্র জানায়, একের পর এক আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় ঝিনাইদহ-১ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আব্দুল হাই ও চট্টগ্রাম-১৬ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীসহ আরও কয়েকজন প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। বর্তমানে সংশ্লিষ্ট শাখায় এ বিষয়ে চিঠি প্রস্তুতসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম চলছে। গতকাল এ তালিকায় যুক্ত হয়েছেন বরগুনা-১ আসনের বর্তমান এমপি ও আওয়ামী লীগ প্রার্থী ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুসহ আরও তিনজন। এ ছাড়া আরও রয়েছেন নারী ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী গাজীপুর-৫ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মেহের আফরোজ চুমকির এপিএস মো. মাজেদুল ইসলাম। তাদের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইসির অনুসন্ধান কমিটিকে বারবার বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর কারণে শম্ভুর বিরুদ্ধেই তিনটি মামলা হতে পারে। অনুসন্ধান কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন ও সুপারিশের ভিত্তিতে ইসির অনুমোদনের পর সংশ্লিষ্ট জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করতে নির্বাচন কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হবে।
ইসির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বরগুনা-১ আসনের ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ও তার সমর্থক জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর কবির, একই দলের সদর উপজেলা শাখার সভাপতি ছিদ্দিকুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শাহ মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ ওলি, আমতলী পৌরসভার মেয়র মতিয়ার রহমান, তালতলি উপজেলা চেয়ারম্যান এম এ কাদেরসহ আরও কয়েকজনের আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় নির্বাচন অনুসন্ধান কমিটি অর্থদণ্ডের সুপারিশ করে কেন্দ্রে প্রতিবেদন পাঠায়। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে মামলা করার জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাচন অফিসারকে নির্দেশ দেওয়ার জন্য ইসির কাছে সুপারিশ করেছে। এর আলোকেই মামলার সিদ্ধান্তের জন্য ফাইল তৈরি করা হচ্ছে। এর আগে একাধিকবার এ প্রার্থীকে সতর্ক করে অনুসন্ধান কমিটি। আর মেহের আফরোজ চুমকির এপিএস মাজেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ১০-১২ জন লোকসহ স্বতন্ত্র প্রার্থী আখতারউজ্জামানের সমর্থক আবদুর রহিম শিকদারের ওপর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চড়াও হন এবং মারধর করেন। এ ছাড়া হুমকি দেন—‘আখতারউজ্জামানের হয়ে নির্বাচন করলে তাকে মেরে ফেলে লাশ গুম করা হবে।’ এ বিষয়ে নির্বাচন অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। ফলে এর আলোকে মামলার সিদ্ধান্তের জন্য সুপারিশ করে কমিটি।
এর আগে ঝিনাইদহ-১ আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী আব্দুল হাই এবং তার সমর্থক শৈলকুপা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল হাকিমের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগে জুডিশিয়াল আদালতে মামলার সিদ্ধান্ত নেয় ইসি। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, গত ১০ ডিসেম্বর শৈলকুপা থানার ১৪ নম্বর দুধসর ইউনিয়নের ভাটই বাজারে আব্দুল হাই এবং তার অনুসারীরা দেশি অস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে মহাসড়কে মহড়া দেন। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ঝিনাইদহ-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য আব্দুল হাই এবং তার সমর্থক ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল হাকিমের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়টি এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতার বাকি রয়েছে। মামলার তালিকায় আরও রয়েছেন চট্টগ্রাম-১৬ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী এবং খুলনা-৩ আসনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী এসএম কামালের সমর্থক জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আজগর বিশ্বাস তারা ও সিলেট-২ আসনের প্রার্থিতা বাতিল হওয়া মো. মোশাহিদ আলী। এ ছাড়া আরও কয়েক প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধেও আচরণবিধি লঙ্ঘনের তথ্য রয়েছে ইসিতে। ক্রমান্বয়ে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এর আগে ইসির নির্দেশনায় করা মামলায় নরসিংদী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আহসানুল ইসলাম রিমন ২০ দিন কারাভোগের পর গতকাল বৃহস্পতিবার হাইকোর্ট থেকে জামিন পান।
নির্বাচন কমিশনার বেগম রাশেদা সুলতানা গতকাল বৃহস্পতিবার নাটোরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রার্থীদের আচরণবিধি মানাতে আরও কঠের হচ্ছে ইসি। এরই মধ্যে অনেক প্রার্থীকে আচরণবিধি ভঙ্গের কারণে শোকজ এবং সতর্ক করা হয়েছে। আইন অমান্য করে কেউ পার পাবে না।’