দায়িত্বপ্রাপ্তদের অবহেলায় ধীরগতিতে এগোচ্ছে দেশের ১ হাজার ৮০০ মাদ্রাসার অবকাঠামো উন্নয়ন কাজ। এরই মধ্যে ৫ বছর কাটলেও মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের ৬ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পের আওতায় মাত্র ৬৪৪টি মাদ্রাসার ভবন নির্মাণ শেষ হয়েছে। এখনো শুরুই হয়নি ২১৯টি মাদ্রাসার কাজ। এ ছাড়া শুরু হওয়ার পর প্রাথমিক বা মাঝামাঝি পর্যায়ে আছে বেশিরভাগ ভবন নির্মাণ। ফলে বেঁধে দেওয়া সময় অনুযায়ী আগামী জুনে এই প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নাম অন্তর্ভুক্তিসহ বিভিন্ন পর্যায়ে অনিয়ম এবং প্রকল্প পরিচালকের অনীহার কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতকরণ, ডিজিটাল বাংলাদেশে লক্ষ্য অর্জন, এসডিজি-৪ বাস্তবায়ন ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ৬ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক। ‘নির্বাচিত মাদ্রাসাসমূহের উন্নয়ন’ নামে এই প্রকল্পের পুরো অর্থ বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ৮০০ মাদ্রাসায় ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। দেশের ৩০০টি নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্যরা ছয়টি করে মাদ্রাসার তালিকা দিয়েছেন।
জানা গেছে, এই প্রকল্পের আওতায় নির্বাচিত মাদ্রাসাগুলোতে চার ও ছয়তলা ভবন নির্মাণ ও বিদ্যমান ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া এসব মাদ্রাসায় নতুন আসবাব ও কম্পিউটার সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা রয়েছে।
নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, শুরুতে ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। পরবর্তী সময়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। প্রথম সংশোধিত প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে ৬ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা করা হয়।
গত অক্টোবর পর্যন্ত অগ্রগতি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নির্মাণকাজ শুরু হওয়া ১ হাজার ৫৮১টি মাদ্রাসার মধ্যে কাজ শেষ হয়েছে ৬৪৪টির। কাজ চলমান রয়েছে ৯৩৭টিতে। অন্যদিকে ২১৯টির কাজই শুরু হয়নি। এর বাইরে আসবাব সরবরাহ করা হয়েছে মাত্র ৭১টি মাদ্রাসায়। শিক্ষক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৫৩ জনকে। এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি ১১.৭০ শতাংশ। আসবাব সরবরাহের জন্য মাদ্রাসা প্রধানরা প্রতিনিয়ত প্রকল্প অফিস ও মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কার্যালয়ে ধরনা দিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ‘মাদ্রাসাগুলোর যে তালিকা দেওয়া হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল সেখানে মাদ্রাসা নেই। এই তালিকা সংশোধন করতে হয়েছে। যে কারণে কিছুটা দেরি হতে পারে।
আবার প্রকল্প পরিচালকও পরিবর্তন হয়েছে। নতুন প্রকল্প পরিচালক যোগ দিতে গড়িমসি করেছেন। সব মিলিয়ে দেরি হয়েছে। এখন থেকে যাতে কাজটি দ্রুত হয়, সেজন্য তাগাদা দেওয়া হবে।’
জানা গেছে, শুরু থেকে এ পর্যন্ত তিনজনকে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সর্বশেষ দায়িত্ব পান মো. দীন ইসলাম। তবে কাঙ্ক্ষিত পদায়ন না হওয়ায় তিনি দায়িত্ব বুঝে নিতে ছয় মাস দেরি করেন।
মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের মতো যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা এবং পাবলিক প্রকিউরমেন্ট সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই প্রকল্প পরিচালকের। যে কারণে প্রকল্পটির সামগ্রিক অগ্রগতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়েই প্রকল্প পরিচালক শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদকে এই প্রকল্পে পদায়ন করার জন্য চিঠি দেন, যা দাপ্তরিক শিষ্টাচার বহির্ভূত। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে মাদ্রাসা উন্নয়ন প্রকল্পে একজন সহকারী প্রকৌশলীকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়। কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগকেও বিষয়টি অবহিত করা হয়নি। এতে সরকারি কাজে প্রচলিত রীতি লঙ্ঘিত হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আসবাব ক্রয় কাজে বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে এর আগে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে বেনামে একটি অভিযোগ করা হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে করা তদন্তে অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। এরপর ভবিষ্যতে কেনাকাটার ক্ষেত্রে আরও সাবধানতা অবলম্বনের জন্য প্রকল্প পরিচালককে পরামর্শ দেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও আসবাব ক্রয় কেনায় একাধিক অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা (পিপিআর) ২০০৮ অনুযায়ী, ই-জিপি সিস্টেমে পরিচালিত টেন্ডার কাজে তিন সদস্যবিশিষ্ট দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিতে প্রকল্প অফিস বহির্ভূত সর্বোচ্চ একজন সদস্য রাখার বিধান রয়েছে। তবে এখানে অফিস বহির্ভূত দুজন (একজন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও একজন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি) এবং একজন প্রকল্প কর্মকর্তা সমন্বয়ে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ ছাড়া যেসব আসবাব ক্রয় করা হবে তার বাজারমূল্য যাচাই না করে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এদিকে তাড়াহুড়ো করে প্রায় ৩০টি প্যাকেজে দরপত্র আহ্বান করা হলেও আসবাব তৈরির কাজে স্বনামধন্য ও যোগ্য তেমন কোনো কোম্পানি দরপত্রে অংশগ্রহণ করছে না।
মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, প্রকল্প পরিচালকের অযোগ্যতার কারণে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়েছেন। মহাপরিচালকের চাপে প্রকল্প মেয়াদ শেষ হওয়ার মাত্র ছয় মাস আগে তড়িঘড়ি করে আসবাব ক্রয়ের জন্য ২০০ কোটি টাকার ৩০টি প্যাকেজে টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। কিন্তু ক্রয় কাজে বিভিন্ন অনিয়ম রয়েছে। পিপিআর অনুযায়ী বাজার দর যাচাই না করে দর নির্ধারণ ও বিধিমতো মূল্যায়ন কমিটি করে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) আইন লঙ্ঘন করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হাবিবুর রহমান ও পরিচালক (প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন) মো. জিয়াউল আহসান এবং প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক মো. নুরুজ্জামান মল্লিক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ড. ফরিদ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সবেমাত্র এখানে যোগদান করেছি। এই প্রকল্পের বিষয়ে তেমন কিছু জানি না। কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে খতিয়ে দেখা হবে।’
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদার বলেন, ‘প্রকল্প সহযোগী হিসেবে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের সঙ্গে কাজ করছি। প্রকল্প পরিচালক একজন সহকারী প্রকৌশলীকে প্রকল্পে পদায়নের জন্য আবেদন করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে একজনকে সেখানে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাকে প্রকল্প পরিচালক দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিতে কেন রেখেছেন বা কোথায় রাখবেন—সে বিষয়ে তিনিই ভালো বলতে পারবেন।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ‘নির্বাচিত মাদ্রাসাসমূহের উন্নয়ন’ প্রকল্পের পরিচালক মো. দীন ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ৭১৩ মাদ্রাসা নির্মাণ হয়েছে। তবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকল্পের বাকি কাজ শেষ করা সম্ভব নয়। করোনাভাইরাসের কারণে প্রকল্পে ধীরগতি ছিল। এরপর আমাকে নিয়োগ করা হলেও যোগদানের ইচ্ছে ছিল না। পাশাপাশি বাজারদর ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় কিছুটা দেরি হয়েছে। অনেক প্রকল্পই সংশোধন করতে হয়। এটিও করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘অবকাঠামো নির্মাণ করছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। প্রকল্পে বা মূল্যায়ন কমিটিতে যাদের নেওয়া হয়েছে, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরসহ ঊর্ধ্বতনদের অনুমতি নিয়েই করা হয়েছে। আর প্রশিক্ষণ মডিউল তৈরি, প্রশিক্ষকের সময় অনুযায়ী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে গিয়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণ ঠিকমতো দেওয়া সম্ভব হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আসবাব কেনার দরপত্রে যদি কেউ অংশ না নেয়, তাহলে কিছু করার নেই। কারণ ডিপিপির বাইরে আমরা যেতে পারব না।’